ডা. রায়হান শরীফ প্রচুর বিদেশি অ্যাকশন মুভি দেখতেন। সেটা তার আচরণে প্রকাশ পেত।তিনি ক্লাসে ছাত্রদের সামনে নিজেকে অ্যাকশন মুভির ভিলেন হিসেবে উপস্থাপন করতেন। মাঝে মাঝে সেসব সিনেমার ডায়ালগও দিতেন।
বুধবার (৬ মার্চ) শহীদ এম মনসুর আলী কলেজের একাধিক শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে আরাফাত আমিন তমালকে গুলি করা শিক্ষক ডা. রায়হান শরীফের চাঞ্চল্যকর এসব তথ্য উঠে আসে।
ওই কলেজের কমিউনিটি মেডিসিন বিভাগের বিভিন্ন বর্ষের একাধিক শিক্ষার্থী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ডা. রায়হান শরীফের পারসোনাল একটি ব্যাগ থাকতো। ওই ব্যাগে এক বা দুটি পিস্তল, অনেকগুলি ছুরি, খুর অন্যান্য অস্ত্রও থাকতো। অস্ত্রের প্রতি তার প্রবল আকর্ষণ ছিল। এ ছাড়াও ব্যাগে ৬/৭টি মোবাইল ফোন থাকতো। তিনি ক্লাসে প্রবেশ করে ব্যাগ থেকে দু-একটি অস্ত্র বের করে টেবিলে রাখতেন। তবে যেদিন বেশি রেগে থাকতেন সেদিন সবগুলো অস্ত্র টেবিলে রেখে ক্লাস করাতেন। শিক্ষার্থীরা তার ক্লাসে ভয়ে থাকতো।
কোনো ছাত্র তার ক্লাস মিস করতে পারতো না। যদি কেউ ক্লাসে না আসে তাহলে অন্য ছাত্রদের ছাত্রাবাসে পাঠিয়ে তাকে ডেকে আনতেন। সে আসার পর তাকে ভর্ৎসনা করতেন। প্রতিদিন ক্লাসে এসে কারও না কারও গায়ে হাত তুলতেন। এটা তার নিত্ত-নৈমিত্তিক অভ্যাসে পরিণত হয়ে উঠেছিল।
শিক্ষার্থীরা বলেন, তিনি প্রচুর অ্যাকশন সিনেমা দেখতেন। নিজেকে এসব সিনেমার ভিলেন মনে করে তৃপ্ত হতেন। ওইসব সিনেমার ডায়ালগ দিতেন ক্লাসরুমে। নিজের ফেবারিট মুভির গান প্রজেক্টরে শোনাতেন। ক্লাসের কোন ছাত্রের আচরণ পছন্দ না হলে পিস্তল বের করে তা থেকে ম্যাগজিন খুলে শ্যুট করে ভয় দেখাতেন।
তিনি শিক্ষার্থীদের টাকায় চা-নাশতা কিনে আনতে বাধ্য করতেন। মাঝেমধ্যে সেই সব চা-নাশতা ছাত্রী হোস্টেলে পৌঁছে দিতে বাধ্য করতেন। একবার পিকনিকের বাসে উঠে পিস্তল বের করে সব ছাত্রদের কাছ থেকে টাকা আদায় করেছেন। তখন এটাকে ছাত্ররা নিছক মজা হিসেবেই নেয়।
সেদিনের ঘটনা
সোমবার (৪ মার্চ) বিকেলে সিরাজগঞ্জ শহীদ এম মনসুর আলী মেডিকেল কলেজের ৩য় বর্ষের একাডেমি ভবনের ৪র্থ তলায় আইটেম পরীক্ষা চলাকালীন শিক্ষক রায়হান শরীফ উত্তেজিত হয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের বকাবকি করেন। একপর্যায়ে ব্যাগ থেকে পিস্তল বের করে আরাফাত আমিন তমাল নামে এক ছাত্রকে গুলি করেন। গুলিটি তমালের ডান পায়ের উরুর উপরের অংশে লেগে গুরুতর আহত হন। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে ডা. রায়হান শরীফকে হেফাজতে নেয়। এ সময় শ্রেণীকক্ষের টেবিল থেকে ১টি বিদেশি পিস্তল ও ১টি গুলির খোসা উদ্ধার করে। পরবর্তীতে গোয়েন্দা পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদের পর তার চামড়ার ব্যাগ থেকে আরও একটি বিদেশি পিস্তল, ৮১ রাউন্ড তাজা গুলি, ৪টি ম্যাগজিন, ২টি বিদেশি কাতানা (ছোরা) ও ১০টি অত্যাধুনিক বার্মিজ চাকু উদ্ধার করা হয়।
সাদিয়া ও লাবিবাসহ ঘটনার একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, মৌখিক পরীক্ষার সময় শিক্ষক রায়হান উত্তেজিত হয়ে বকাবকি করেন। এ সময় আমার একটি পোষা পাখি আছে- এ কথা বলেই তার ব্যাগ থেকে পিস্তল বের করেন। পিস্তল দেখিয়ে বলেন, এটাই আমার পোষাপাখি। ”পিস্তলটি নড়াচড়া করতেই গুলি বের হয়ে তমালের পায়ে লাগে। আরেক শিক্ষার্থী লাবিবার কানের পাশ দিয়ে যায়।
রায়হান শরীফ সম্পর্কে অন্যান্য তথ্য:
রায়হান শরীফ সম্পর্কে তথ্য জানতে শহরের বিএ কলেজ রোডে তাদের নিজস্ব বাসায় গিয়ে কাউকে পাওয়া যায়নি। প্রতিবেশীরা জানায়, শহীদ এম মনসুর আলী মেডিকেল কলেজে গুলির ঘটনার পর থেকেই তার পরিবারের কেউ বাসায় নেই। স্থানীয়দের ধারণা তার বাবা-মা হয়তো সুইজারল্যান্ডে মেয়ের কাছে চলে গেছেন। তার বোন সুইজারল্যান্ড প্রবাসী বলে জানা গেছে। তিনি আগে থেকেই এমন উগ্র মেজাজি বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়। উগ্র আচরণে অতিষ্ঠ হয়ে তার স্ত্রীও তাকে ছেড়ে চলে গেছে।
সিরাজগঞ্জ জেলা ছাত্রলীগের সাবেক নেতা আশিক ইমরান বলেন, ৭/৮ দিন আগে শহরের মুক্তাপ্লাজার সামনে দিয়ে একটি রিকশায় যাচ্ছিলেন রায়হান শরীফ। এ সময় অপর একটি রিকশার সঙ্গে ধাক্কা লাগায় তার সঙ্গে রিকশাওয়ালার কথা কাটাকাটির হয়। একপর্যায়ে রিকশাওয়ালাকে চড় মারেন। পরে ব্যাগের চেইন খুলে পিস্তল বের করেন। ওই পিস্তল দিয়ে রিকশাওয়ালাকে মারেন এবং গালি দিতে দিতে চলে যান।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাজশাহী মেডিকেল কলেজের ৫২তম ব্যাচের ছাত্র রায়হান শরীফ মেডিকেল কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি ছিলেন। সেখান থেকে পাস করে বের হওয়ার পর ২০১৭ সালে নর্থ বেঙ্গল মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের চিকিৎসক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। লিয়াকত নামে ওই হাসপাতালের এক চিকিৎসকের মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে হুমকি দেওয়ার অভিযোগে চাকরিচ্যুত হন। এরপর বিসিএসে নিয়োগ পেয়ে রাজশাহীর গোদাগাড়ী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মেডিকেল অফিসার হিসেবে যোগ দেন। সেখান থেকে শহীদ এম মনসুর আলী মেডিকেল কলেজে বদলি হয়ে আসেন।
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন সিরাজগঞ্জ শাখার সভাপতি ও নর্থ বেঙ্গল মেডিকেল কলেজের কমিউনিটি মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. জহুরুল হক রাজা বলেন, ডা. রায়হান প্রায়শই অস্ত্র বের করে ভয় দেখাতেন। তার জন্য হাসপাতালে একটি ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি হতো। কয়েক বছর আগে হাসপাতালের শিশু বিভাগের প্রধান ডা. লিয়াকত আলীর মাথায় পিস্তল ধরে হত্যার হুমকিও দিয়েছিলেন তিনি। এসব অভিযোগে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাকে চাকরিচ্যুত করে।
শহীদ এম মনসুর আলী মেডিকেল কলেজের কমিউনিটি মেডিসিন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ডা. মোহসেনুল মোমিন বলেন, এক বছর দুই মাস আগে এখানে প্রভাষক পদে যোগদান করেন রায়হান। এরপর কিছুদিন ফরেনসিক বিভাগে অতিরিক্ত দায়িত্বে ছিলেন। গত ডিসেম্বরে ঢাকায় জাতীয় পরিকল্পনা ও উন্নয়ন একাডেমিতে (এনএপিডি) তিন মাসের বুনিয়াদি প্রশিক্ষণে অংশ নেন। ফেব্রুয়ারিতে প্রশিক্ষণ শেষে আসেন। তাই তার সাথে খুব একটা দেখা সাক্ষাত হয়নি। প্রথম দিকে আমার বেশি দেখা সাক্ষাত ও যোগাযোগ হতো। তখন তার মধ্যে তেমন কোনো উগ্র আচরণ আমি লক্ষ্য করিনি।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ডা. নওশাদ আলী বলেন, আমাদের ছাত্র ছিল রায়হান শরীফ। যতটুকু দেখেছি একটু উগ্র ও বেয়ারা টাইপের ছেলে ছিল। হুট করেই মাথা গরম করে। সিরাজগঞ্জ মনসুর আলী কলেজের ঘটনাটি শিক্ষকদের জন্য খুবই লজ্জাজনক।
ডা. রায়হান শরীফ বরখাস্ত: শিক্ষার্থীদের আন্দোলন প্রত্যাহার
বুধবার (৬ মার্চ) সকাল থেকেই ক্লাস বর্জন করে কলেজ ক্যাম্পাসের বাইরে মানববন্ধন ও অবস্থান কর্মসূচির প্রস্তুতি নেন শিক্ষার্থীরা। তবে পুলিশ ও কলেজ প্রশাসনের হস্তক্ষেপে তারা এসব কর্মসূচি থেকে সরে আসেন। একপর্যায়ে অভিযুক্ত শিক্ষক রায়হান শরীফের সাময়িক বরখাস্তের খবরে আশ্বস্ত হয়ে ক্লাস বর্জন প্রত্যাহার করে নেন তারা।
কলেজের ছাত্র ইন্টার্ন চিকিৎসক মোহাম্মদ রাহাত বলেন, আমরা সকাল থেকেই ক্লাস বর্জন করে আন্দোলনে ছিলাম। স্যারদের কাছে কিছু দাবি জানিয়েছি। স্যাররাও আমাদের আশ্বস্ত করেছেন। তাছাড়া শিক্ষক রায়হান শরীফকে বরখাস্ত করা হয়েছে। তাই আমরা ক্লাস বর্জনের আন্দোলন প্রত্যাহার করেছি। কাল থেকেই আমরা ক্লাসে ফিরবো। তবে ওই শিক্ষকের বিচার না হওয়া পর্যন্ত পোস্টারিং, সভা সেমিনারসহ অন্যান্য আন্দোলন চালিয়ে যাবো।
কলেজের অধ্যক্ষ ডা. আমিরুল হোসেন চৌধুরী বলেন, ছাত্রদের দাবি ছিল শিক্ষক রায়হান শরীফ যাতে কলেজে না থাকে। ইতিমধ্যে স্বাস্থ্য বিভাগ ওই শিক্ষককে সাময়িক বরখাস্ত করেছে। ছাত্ররাও তাদের ক্লাস বর্জনের আন্দোলন প্রত্যাহার করে নিয়েছে।
৭ দিনের রিমান্ড আবেদন
সিরাজগঞ্জ গোয়েন্দা পুলিশের ওসি মো. জুলহাজ উদ্দীন বলেন, ডা. রায়হান শরীফের বিরুদ্ধে দুটি মামলা হয়েছে। গুলিবিদ্ধ শিক্ষার্থী তমালের বাবা আব্দুল্লাহ আল-আমিন বাদী হয়ে হত্যাচেষ্টা মামলা দায়ের করেন। ওই মামলায় মঙ্গলবার সিরাজগঞ্জ অতিরিক্ত চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন তিনি। অপরদিকে গোয়েন্দা পুলিশের উপ-পরিদর্শক আব্দুল ওয়াদুদ বাদী হয়ে অস্ত্র আইনে অপর একটি মামলা দায়ের করেন। এ মামলায় অধিকতর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রায়হান শরীফের বিরুদ্ধে সাত দিনের রিমান্ড আবেদন করা হয়েছে। তবে রিমান্ড শুনানির দিন ধার্য হয়নি।
ডিবির ওসি আরও বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তিনি স্বীকার করেছেন কুষ্টিয়ার ভেড়ামারার এক ব্যক্তির কাছ থেকে অস্ত্রগুলো কিনেছেন। প্রতিটি পিস্তল তিনি ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা করে কিনেছিলেন। তার কাছ থেকে পাওয়া সবগুলো অস্ত্রই ছিল অবৈধ। অস্ত্রের প্রতি তাঁর বিশেষ আকর্ষণ ছিল। এসব অস্ত্র কেনা ও তা বহন করা তার একটা শখ বলে জানিয়েছেন। তার ফোনে অসংখ্য বিদেশি পিস্তলের ছবিও রয়েছে।
শহীদ এম মনসুর আলী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ আমিরুল হোসেন চৌধুরী বলেন, সেই ছেলে আগে থেকেই মারদাঙ্গা টাইপের। পিস্তল নিয়ে ঘোরাফেরা করে ক্যাম্পাসে। ওপেন টেবিলের ওপর পিস্তল রেখে ক্লাস করে। যারে যখন পারে পিস্তল নিয়ে হুমকি দেয়। এতদিন কেউ তার ভয়ে মুখ খোলেনি। এখন নানান কথা বেরিয়ে আসছে। এত ইনফরমেশন আগে আমরা জানতাম না। আমি বিভিন্ন সূত্র থেকে জেনেছি তিনি ক্লাসে অস্ত্র প্রদর্শন করেছেন। সে জন্য আমি তাৎক্ষণিকভাবে শোকজ করেছি। তিনি শোকজের জবাব না দিয়ে ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করেছেন। আমরা দ্বিতীয়বার শোকজন করেছি। নিয়ম অনুযায়ী তিনটা শোকজের পরে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়। আমরা সেই প্রক্রিয়ার মধ্যেই ছিলাম। তার বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছিল। তারা এখন পর্যন্ত ব্যবস্থা নেয়নি। তাকে বদলি করার জন্য কয়েকবার চেষ্টা করেছি কিন্তু হয় নাই।