কেরানীগঞ্জের গোলামবাজার এলাকার বড় মসজিদ পেরিয়ে কিছুটা সামনে এগিয়ে এক পথচারীর কাছে জানতে চাইলে পাশের এক মহল্লার গলির দিকে আঙুল উঁচিয়ে দেখিয়ে দিলেন ‘জল্লাদ’ শাহজাহানের চায়ের দোকান। বুঝতে কষ্ট হলো হলো না, ঠিক জায়গাতেই এসেছি, আর শাহজাহানও বেশ পরিচিত মুখ।
ওই পথচারীর দেখানো গলিতে কয়েক পা ডানে মোড় নিতেই দুটি চায়ের দোকান দেখা গেল। সামনে যেতেই একটি দোকানে ‘জল্লাদ’ শাহজাহানকে চোখে পড়ল। বিক্রেতার আসনে বসে ছোট ছুরি দিয়ে চা বানানোর কনডেন্সড মিল্কের কৌটা কাটছিলেন। চিনতে কষ্ট হয়নি একটুও। মাস ছয়েক আগেই গণমাধ্যমে বেশ পরিচিত মুখ ছিলেন তিনি।
দোকানে ঢুকে পরিচয় দিয়ে তার কাছে জানতে চাইলাম ‘কেমন আছেন’। উত্তরে ‘ভালো’ বললেও, চেহারায় বিন্দুমাত্র প্রমাণ ছিল না। বরং, হতাশার ছাপ ছিল স্পষ্ট। তাই অন্য আলাপে যাওয়ার আগে চা চাইলাম তার কাছে। তারপর কিছুক্ষণ নীরবে কনডেন্সড মিল্কের কৌটার মুখ কাটলেন তিনি। একটু সময় নিয়ে চা বানালেন। তার চা বানানো দেখে অপরিচিত কেউ তাকে আনাড়ি ভাবলেও, বোঝার উপায় নেই- এ দুই হাতেই তিনি ৬০ জনের ফাঁসির দড়ি টেনেছেন।
যদিও কারাগারের রেকর্ড বলছে, ২৬ জনের ফাঁসি কার্যকর করেছেন ‘জল্লাদ’ শাহজাহান, যা তার হিসাবের অর্ধেকেরও কম। হিসাব যাই হোক, বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি মানুষের ফাঁসির দড়ি টানার রেকর্ড তারই।
‘জল্লাদ’ শাহজাহানের পুরো নাম শাহজাহান ভূঁইয়া, নরসিংদী জেলার পলাশ উপজেলার গজারিয়া ইউনিয়নের ইছাখালী গ্রামের মৃত হাছেন আলীর ছেলে। মায়ের নাম মেহের। ১৯৫০ সালের ২৬ মার্চ জন্ম নেওয়া শাহজাহানের বয়স এখন ৭৪ বছরের কিছু কম। যৌবনকালসহ জীবনের দীর্ঘ সময় কারাগারে বন্দি থাকায় ব্যক্তিগত জীবনেও তিনি অবিবাহিত।
দীর্ঘ ৩১ বছর ৬ মাস ২ দিন কারাভোগের পর ২০২৩ সালের ১৮ জুন দুপুরে কারাগার থেকে মুক্তি পান শাহজাহান। ডাকাতি করতে গিয়ে হত্যা ও অস্ত্র আইনের দুই মামলায় তার ৪২ বছরের কারাদণ্ড হয়েছিল। কিন্তু কারাগারে জল্লাদের কাজ, সুশৃঙ্খল জীবনযাপন আর ভালো কাজের পুরস্কার হিসেবে তিনি ১০ বছর ৫ মাস ২৮ দিন রেয়াত (সাজা মওকুফ) পান। ওই দুই মামলায় তার পাঁচ হাজার টাকা করে মোট ১০ হাজার টাকা জরিমানা হয়। মুক্তির সময় কারা কর্তৃপক্ষ তা পরিশোধ করে দেয়।
সেই ভয়ংকর ‘জল্লাদ’ শাহজাহান এখন চা বিক্রেতা। গোলামবাজারের একটি মহল্লার গলির ভেতর চায়ের দোকান দিয়েছেন গত নভেম্বরে। দোকানের নাম এখনো না দিলেও ‘জল্লাদ শাহজাহান টি স্টল’ নাম দেবেন বলে জানালেন তিনি। গুগল ম্যাপে এরইমধ্যে এ নামে শাহজাহানের চায়ের দোকানটি পরিচিতি পেয়েছে। ছোটখাটো সাধারণ দোকানটিতে অনেক বেশি পণ্য নেই। চায়ের পাশাপাশি সিগারেট, বিস্কুট, চিপস, কেক, লজেন্স, নুডুলসের প্যাকেট বিক্রি করেন তিনি। আবার লুডুর বোর্ড, হুইল পাউডার ও লাইটের মতো প্রয়োজনীয় পণ্যও রেখেছেন। দোকানে আসা ক্রেতাদের জন্য আছে চেয়ার- টেবিলেরও ব্যবস্থা।
চায়ে চুমুক দিয়ে শাহজাহান ভূঁইয়ার কাছে জানতে চাইলাম কারাগার থেকে চায়ের দোকানে আসার গল্প। তিনি বলেন, ‘কারামুক্ত হওয়ার পর প্রথম কিছুদিন রাজধানীর নর্দ্দায় রিপন দেওয়ান নামে এক শুভাকাঙ্ক্ষীর বাসায় ছিলাম। কারাগারে পরিচয় হয়েছিল তার সঙ্গে। পরে কয়েক মাস ছিলাম বাবুবাজারে। পরিচিত কয়েকজন সেখানে থাকার ব্যবস্থা করে দেন। এরপর গোলাম বাজারে আসি। এখন এখানেই থাকি। একটি চায়ের দোকান দিয়েছি। ’
শাহজাহান ভূঁইয়া গোলাম বাজারে যে বাসায় থাকছেন, সেটির ভাড়া মাসে সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা। অন্যান্য খরচ মিলে যা ছয় হাজার টাকায় গিয়ে দাঁড়ায়। আবার চায়ের দোকানের ভাড়া দেন প্রতি মাসে ছয় হাজার টাকা। দোকান নিতে অ্যাডভান্স দিতে হয়েছে ২০ হাজার টাকা।
এখন চায়ের দোকানের মালিক হলেও কারাগার থেকে বের হওয়ার সময় শাহজাহানের কাছে টাকা-পয়সা ছিল না। তাহলে কীভাবে এতদিন চললেন, আর কীভাবে এ চায়ের দোকান দিলেন- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কারাগার থেকে বের হওয়ার পর শুভাকাঙ্ক্ষীরা প্রথমে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন। পরে তাদের কাছ থেকে ধার-দেনা করে চলেছি, সরকারের কাছ থেকেও এককালীন কিছু সহযোগিতা পেয়েছি। কিন্তু কতদিন আর ধার-দেন করা যায়? তাই মানুষের কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা ধার নিয়ে চায়ের দোকান দিয়েছি। এ চায়ের দোকান দেওয়ারই সামর্থ্য ছিল। বড় ব্যবসা করতে টাকা বেশি লাগে। গরিব মানুষ বড় ব্যবসা কীভাবে শুরু করব?
চায়ের দোকানের আয় দিয়ে শাহজাহানের জীবন যে ভালোভাবে চলছে না, সেটি প্রথমেই তার ‘ভালো আছি’ উত্তরে বোঝা যায়। তারপরও জানতে চাইলে তিনি বলেন, চা বিক্রি করে জীবন চলে না। আয় বলতে তেমন কিছুই হয় না। সারাদিনে ২০-৫০ কাপ চা বিক্রি করি। এর থেকে বেশি বিক্রি করতে পারি না। আমার এখন বয়স অনেক। এখন তো আর কাজ-কর্ম করে খেতে পারব না। কাজ করা আমার পক্ষে সম্ভব না। তাহলে আমি কী করে খাবো? কিছু অর্থ পেয়েছি সরকারের পক্ষ থেকে। আর মানুষের কাছ থেকে ধার দেনা করে এই দোকানটা দিয়েছি, নিজেও চলেছি। কিন্তু এই দোকান দিয়ে তেমন চলে না। আল্লাহর কাছে অনেক কান্নাকাটি করেছি। কোনোই লাভ হলো না। ’
ছাত্রজীবনে স্থানীয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়া শাহজাহান অপরাধ জগতে ঢুকতেও বেশি সময় নেননি। ডাকাতি ও খুনের মতো ভয়ংকর সব অপরাধ করার পর ১৯৯১ সালের ১৭ ডিসেম্বর তিনি প্রথম গ্রেপ্তার হয়ে মানিকগঞ্জ জেলা কারাগারে আসেন। এরপর দুই মামলায় দোষী সাব্যস্ত হলে ৪২ বছরের কারাদণ্ড হয় তার। কারাগারে তার কয়েদি নম্বর ছিল ২৫৮৯/এ। সাজা কমাতে কারা কর্তৃপক্ষের কাছে জল্লাদ হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেন। এরপর সহযোগী হিসেবে গফরগাঁওয়ের নূরুল ইসলামকে ফাঁসি দিয়ে জল্লাদ জীবন শুরু করেন তিনি। এক সময় মানিকগঞ্জ জেলা কারাগার থেকে ঢাকা সেন্ট্রাল কারাগারে আনা হয় শাহজাহানকে। সেখানে তাকে প্রধান জল্লাদের আসন দেওয়া হয়।
শাহজাহান ভূঁইয়া বলেন, ‘প্রথম ধরা খাই মানিকগঞ্জে। ওখানে ১২ বছর ছিলাম। এরপর ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে আনা হয়। ১৯৯৮ সালে প্রথম ফাঁসি দিয়েছিলাম। ’
কারাগারের নথি অনুযায়ী, ‘জল্লাদ’ শাহজাহান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় ঘাতক (বজলুল হুদা, মুহিউদ্দিন, সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, মহিউদ্দিন আহমেদ, আবদুল মাজেদ), চার যুদ্ধাপরাধী (জামায়াত নেতা আব্দুল কাদের মোল্লা, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, মীর কাসেম আলী), কুখ্যাত সন্ত্রাসী এরশাদ শিকদার, জঙ্গি নেতা বাংলা ভাই ও আতাউর রহমান সানী, শারমীন রীমা হত্যার আসামি খুকু মনির ও ডেইজি হত্যা মামলার আসামি হাসানসহ আলোচিত ২৬ জনের ফাঁসি কার্যকর করেন।
ফাঁসি দেওয়ার মতো ভয়ংকর কাজ করতে আবেগ কাজ করলেও কখনো ভয় বা খারাপ লাগেনি শাহজাহানের। এটিকে কাজ হিসেবেই দেখেছেন তিনি। শাহজাহান বলেন, ‘আমার কোনো খারাপ লাগেনি। তবে কিছু না কিছু তো থাকেই। তারপরও কাজ তো করতে হবেই। খারাপ লাগলেও কিছু করার নেই, কোনো লাভ নেই। এটি ছিল আমার একটি কাজ। সাজা হলে জেলখানায় কাজ দেওয়া হয়। এটি ছিল আমার কাজ। ’
সাধারণ মানুষ থেকে অপরাধী, অপরাধী থেকে কয়েদি, কয়েদি থেকে আবার সাধারণ মানুষ। তিনটি আলাদা আলাদা জীবন শাহজাহানের। এর মাঝে কারাগারের চার দেয়ালের মধ্যে কেটেছে দীর্ঘ সময়। নিজের অপরাধ স্বীকারও করেন শাহজাহান। তবে এখন আর কোনো অপরাধবোধ কাজ করে না তার মধ্যে।
শাহজাহান বলেন, ‘অপরাধ যখন করেছি, তখন অপরাধবোধ কাজ করত মনের ভেতর। আর যখন জেলে গেলাম, তখন বুঝেছি অপরাধ করা ঠিক হয়নি। আর এখন একেবারে ফ্রেশ হয়ে বের হয়েছি। জীবনে আর কোনো অন্যায় করব না, পাপ কাজ করব না। এখন আর কোনো অপরাধবোধ নেই। অপরাধের জন্যই তো এত বছর জেলে থেকেছি। ’
শাহজাহান যেন এখন ‘নিষ্পাপ’ এক মানুষ। প্রতিবেশীরা তার সঙ্গে হেসে কথা বলছেন, খোঁজ খবর নিচ্ছেন। অনেকেই তাকে দেখতে, ছবি তুলতে তার চায়ের দোকানে আসছেন, চা খাচ্ছেন। জল্লাদ হিসেবে কাজ করার পরও তার প্রতি কারো ঘৃণা বা ভয় চোখে পড়েনি।
তিন বোনের মধ্যে বর্তমানে এক বোন বেঁচে আছেন শাহজাহানের। তিনি গ্রামের বাড়িতে থাকেন ছেলেসহ। শাহজাহানও তাদের সঙ্গে দেখা করতে যান।
আসন্ন অমর একুশে বইমেলায় শাহজাহানের কারাগার জীবন ও জল্লাদ জীবন নিয়ে একটি বই প্রকাশিত হতে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন জানান তিনি। ‘কেমন ছিল জল্লাদ জীবন’ নামের বইটি কিংবদন্তি পাবলিকেশন থেকে প্রকাশ করছেন প্রকাশক অঞ্জন হাসান পবন।
শাহজাহান বলেন, ‘একুশে বইমেলায় আমার একটি বই বের হচ্ছে। ‘কেমন ছিল জল্লাদ জীবন’। বইটি পড়লে সবাই জানতে পারবেন আমার আত্মজীবনী সম্পর্কে। কেমন ছিল আমার সাধারণ জীবন, অপরাধ জীবন। সবকিছু জানতে পারবে। এখন বইটি পড়ে কেউ ভালো হতে চাইলে ভালো হতে পারবে, খারাপ হতে চাইলে খারাপও হতে পারে। ’
সরকারের কাছে সাহায্যও কামনা করেছেন বয়সের ভারে ন্যুব্জ শাহজাহান। পাশাপাশি জীবনের শেষ ইচ্ছা হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার আকাঙ্ক্ষার কথাও জানান বাংলানিউজকে। তিনি বলেছেন, ‘সরকারের সাহায্য কামনা করি। তাহলে আমার উপকার হবে। আমি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করব। কারণ,তার বাবাকে যারা হত্যা করেছে, তাদের আমি ফাঁসিতে ঝুলিয়েছি। আমার শেষ ইচ্ছা তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করা, তাকে সালাম দেওয়া। চাওয়া পাওয়ার কিছু নেই। তার কাছে চাওয়ার মতো কিছু নেই। দুনিয়াতে চাওয়ার মতো কিছু নেই। তার সঙ্গে দেখা করতে পারলে খুশি হতাম। তার বাবার খুনিদের ফাঁসি দিয়ে আমি আনন্দ পেয়েছি। তিনি যদি একটু সহানুভূতি দেখিয়ে আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন, তাহলে আমি নিজেকে ধন্য মনে করতাম। ’