সম্প্রতি দেশজুড়ে বেড়েছে নারীবিদ্বেষী সংঘবদ্ধ তৎপরতা। সমাজের সর্বস্তরের নারীদের ওপর চলমান এসব তৎপরতাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখার কোনো সুযোগ নেই।
এ বাস্তবতায় ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবসকে কেন্দ্র করে নারী সংহতির আয়োজনে ‘নারী মুক্তির আকাঙ্ক্ষা: গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বাস্তবতা’ শীর্ষক মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়।
শনিবার (৮ মার্চ) বেলা ১১টায় নারী সংহতির ২০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে এ মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়।
নারী দিবসের শুভেচ্ছা ও জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে শহীদ ও আহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে মতবিনিময় সভার সূচনা করেন নারী সংহতির সাধারণ সম্পাদক অপরাজিতা চন্দ। সভার সঞ্চালনাকালে তিনি শিশু আসিয়াকে ধর্ষণের ঘটনায় ক্ষোভ ও উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
সভায় সভাপতিত্ব করেন নারী সংহতির সভাপতি ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শ্যামলী শীল।
দেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি বলেন, জুলাই অভ্যুত্থানের পরে নতুন রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে দেশের মানুষ আশাবাদী ছিল। যদিও গত সাত মাসে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি ভয়াবহ অবনতি হয়েছে। আর সেই অবনতির প্রথম শিকার হচ্ছে নারীরা।
লালমাটিয়ায় দুই নারীর ধূমপান নিয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার বক্তব্যের সমালোচনা করে তিনি বলেন, ধূমপানকে সিভিল অফেন্স সেটা চিহ্নিত করলেও স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা নারীর ওপর হামলার বিষয়ে চুপ থাকার মধ্য দিয়ে সমাজে নারীর ওপর সহিংসতাকে একভাবে জাস্টিফাই করলেন। একই সঙ্গে দেশে চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার আহ্বান জানান তিনি।
একই সঙ্গে নারীর ক্ষমতায়নে সংসদে নারী সংরক্ষিত আসন বাড়ানোর দাবি ও সম্পত্তির উত্তরাধিকারে নারীর সমানাধিকারে বিষয়টিকে আবারো সামনে নিয়ে আসেন শ্যামলী শীল।
সভায় আরও বক্তব্য রাখেন বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাব বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক মোশাহিদা সুলতানা। তিনি নারীর আর্থসামাজিক অবস্থা উল্লেখ করে বলেন, নারী দিবসের এতো বছর পরও নারী শ্রমের বিনিময়ে এ সমাজ থেকে কি মর্যাদা পাচ্ছেন সেটা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে।
আন্তর্জাতিক নারী দিবসে লড়াকু নারীদের ও নারী সংহতির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর শুভেচ্ছা জানিয়ে জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক আনু মুহাম্মদ বলেন, নারী-পুরুষের সবার ঐক্যের মধ্য দিয়ে একটা স্বৈরাচারী শাসককে ক্ষমতা থেকে নামানো সম্ভব হয়েছে।
বর্তমানে দেশে চলমান নৈরাজ্য অবসানে অন্তর্বর্তী সরকারের আরও কঠোর অবস্থান নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, পূর্বের সরকারের মতো সহিংসতা ও নৈরাজ্যের দায় অন্য কারো ওপর চাপিয়ে দিয়ে সাফাই গাইলে হবে না। নিরাপত্তা পরিস্থিতি শক্ত হাতে নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে নারী-পুরুষ বৈষম্য দূর করতে পারিবারিক, ধর্মীয় ও সামাজিক শিক্ষার ওপর জোর দেওয়ার আহ্বান জানান তিনি। রাষ্ট্রের সবক্ষেত্রে নারীদের আরও বেশি সরব হওয়ার প্রতি জোর দেন তিনি।
গণসংহতি আন্দোলনের কেন্দ্রীয় নির্বাহী সমন্বয়কারী আবুল হাসান রুবেল বলেন, দেশের বর্তমান নৈরাজ্যিক পরিস্থিতিকে অন্তর্বর্তী সরকারের যে অগ্রাহ্য করার প্রবণতা দেখা যায় সেটা মোটেই সুস্থ বা স্বাভাবিক নয়। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্য রোধ করতে হবে। দেশে কোনো রাজনৈতিক শক্তি ছাড়া নারী প্রশ্নকে সামনে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব না। এজন্য অভ্যুত্থানের চেতায় উদ্বুদ্ধ ঐক্যবদ্ধ রাজনৈতিক শক্তির উত্থান জরুরি।
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডির) সহ-সভাপতি ও সমাজতান্ত্রিক নারী জোটের সভাপতি তানিয়া রব বলেন, ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। এটা নারীবিদ্ধেষী তৎপরতা বাড়ায়।
জুলাই আন্দোলনের অন্যতম নেতা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সীমা আক্তার বলেন, গণঅভ্যুত্থানে নারীদের অংশগ্রহণ ব্যাপকমাত্রায় থাকলেও পরর্বতীতে নেতৃত্বে বা নীতিনির্ধারক অবস্থানে নারীদের দেখা যায়নি।
নারীগ্রন্থ প্রবর্তনার সীমা দাস সামু শ্রমজীবী নারীদের বেতন বৈষম্য ও স্ববেতনে মাতৃত্বকালীন ছুটি বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেন।
বিএনএসকের সংগঠক এনা সাইমুম রিমা নারীদের একক রাজনৈতিক দল নির্মাণের প্রস্তাবনা দেন।
সভায় উপস্থিত ছিলেন গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি, শিল্পী ও সাংস্কৃতিক কর্মী কৃষ্ণকলি ইসলাম, নারী সংহতির কেন্দ্রীয় নেতা রেবেকা নীলা, গ্রন্থ প্রবর্তনার পরিচালক সীমা দাস সামু, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ড. ফাতেমা সুলতানা শুভ্রা, জাসদ সমাজতান্ত্রিক দল নারী জোটের ঢাকা জেলার সভাপতি ফারজানা জামান দিবা, নারী পক্ষের সৈয়দা সালমা পারভীন, নারীগ্রন্থ প্রবর্তনার সীমা দাস সামু, আইনজীবী আবেদা গুলরুখ, অর্থনীতিবিদ সুজিত চৌধুরী, শৈশবের প্রতিষ্ঠাতা ফারহানা মান্নান, শিল্পী বড়ুয়া, গার্মেন্টস শ্রমিক সংহতির নেতা প্রবীর সাহা, গণসংহতি আন্দোলনের সমন্বয়ক পরিষদের সদস্য জুলহাসনাইন বাবু, সমগীতি সাংস্কৃতিক সংগঠনের অর্ক সুমন, আইনজীবী নাসিমা রহমান তুহিন প্রমুখ।