চোখের সামনে নদীগর্ভে বিলীন হচ্ছে বসতভিটা। ঘরবাড়ি দ্রুত সরাতে না পারলে সব কিছুই ভাসিয়ে নেবে হিংস্র তিস্তা।
ঘরবাড়ি সরানোর শ্রমিক ও পরিবহনে নৌকার তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে নদীপাড়ের ভাঙন কবলিত এলাকায়।
জানা গেছে, তিস্তা, ধরলা আর সানিয়াজান নদী বেষ্টিত জেলা লালমনিরহাট। যার উত্তর সীমান্তে ধরলা নদী আর দক্ষিণ সীমান্তে পুরো জেলাকে ঘিরে রেখেছে হিংস্র তিস্তা নদী। নদীর পানি প্রবাহ কমে গেলেই ভাঙন তীব্র আকার ধারণ করে। গেল বন্যার পানি কমতেই তীব্র ভাঙন দেখা দিয়েছে তিস্তার বাম তীরে অবস্থিত লালমনিরহাটে। ভাঙনের তীব্রতা সব থেকে বেশি হাতীবান্ধা উপজেলার ডাউয়াবাড়ি ইউনিয়নে। সেখানে ছয়টি ওয়ার্ড নদীর তীরে।
উত্তর ডাউয়াবাড়ি গ্রামটি একটি দ্বীপচর। চার দিকে তিস্তা নদী। চলতি মৌসুমে ভাঙনের তীব্রতা দেখা দিয়েছে এ চরে। এ গ্রামের মানুষকে ঘরবাড়ি সরিয়ে নিতে পোহাতে হচ্ছে দুর্ভোগ। কোনো শ্রমিক মিলছে না ঘরবাড়ি সরানোর কাজে। চরের লোকজন একে অপরকে সহায়তা করে ঘরবাড়ি সরিয়ে দিচ্ছেন। সরানোর পরে তা নৌকায় উঠিয়ে নিতে হয় শুকনো স্থানে। এজন্য একেকবার নৌকায় মালপত্র পরিবহনে গুণতে হয় তিন/চার হাজার টাকা। সেই নৌকারও সংকট রয়েছে চরে। শ্রমিক সংকটের কারণে অনেকের অনেক জিনিস ভেসে যাচ্ছে তিস্তার স্রোতে।
ঘরবাড়ি, জিনিসপত্র সরিয়ে নিলেই শেষ হয় না ভাঙনকবলিতদের কষ্ট। নতুন করে ঘরবাড়ি তুলতে প্রথমত প্রয়োজন উঁচু জমি। যার ব্যবস্থা অধিকাংশ মানুষ করতে পারেন না। ফলে বাধ্য হয়ে তাদের জিনিসপত্র বাঁধ বা রাস্তার ধারে ফেলে রেখে খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবন যাপন করতে হচ্ছে। কেউ কেউ আত্মীয়দের বাড়ির উঠানে আশ্রয় নিচ্ছেন। কেউ আবার মোটা অংকের টাকায় জমি লিজ বা ভাড়া নিয়ে মাথা গোজার ঠাঁই গড়ছেন।
গত দুদিনে উত্তর ডাউয়াবাড়ি গ্রামের ৪০টি বসতভিটা, দুটি মসজিদ ও উত্তর ডাউয়াবাড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। ভাঙনের মুখে পড়েছে উত্তর ডাউয়াবাড়ি কমিউনিটি ক্লিনিকসহ অসংখ্য বাড়ি ও স্থাপনা। এসব পরিবারের ঘর বাড়ি ও মালপত্র পরিবহনের জন্য ২৮টি নৌকা বিরতিহীনভাবে চলাচল করছে।
উত্তর ডাউয়াবাড়ি গ্রামের নদী ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত নজরুল ইসলাম, মনজুদার রহমান ও কালাম মিয়া বলেন, চোখের সামনে গ্রামের একের পর এক ঘরবাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। একটি বাড়িতে অনেক জিনিসপত্র থাকে। এসব সরিয়ে নিতেও অনেক লোক লাগে, সময় লাগে। শ্রমিক মেলে না চরে। গ্রামবাসী নিজেরা ও আত্মীয় স্বজনদের ডেকে নিয়ে সরানো হচ্ছে মালপত্র। কিন্তু মালামাল সরানো হলেও নতুন করে ঘরবাড়ি তোলার মত জমি নেই আমাদের। তাই আপাতত ঘরবাড়ি জিনিসপত্র সরিয়ে বিদ্যালয়ের মাঠে রেখেছি।
উত্তর ডাউয়াবাড়ি গ্রামের বাসিন্দা ইউপি সদস্য ওহেদুল ইসলাম বলেন, বর্তমান যে অবস্থা, তাতে এক হাজার টাকা দিলেও শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। গ্রামবাসী মিলে একে অপরের ঘরবাড়ি ও আসবাবপত্র সরিয়ে দিচ্ছেন। শ্রমিক সংকটের কারণে অনেক জিনিসপত্র ভেসে গেছে তিস্তায়। তবুও একটা পরিবারের মালপত্র সরিয়ে নিতে খরচ পড়ে প্রায় ৩০/৪০ হাজার টাকা। যা অনেকের পক্ষে বহন করা অসম্ভব।
ডাউয়াবাড়ি ইউনিয়ন পরিষদের সচিব আজহারুল ইসলাম বলেন, উত্তর ডাউয়াবাড়ি গ্রামের সব মিলে প্রায় একশ পরিবার নদী ভাঙনের শিকার হয়েছে চলতি সৌসুমে। ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা প্রতিনিয়তই বড় হচ্ছে।
শুধু ডাউয়াবাড়ি ইউনিয়নে নয় নদী ভাঙনের শিকার হচ্ছে জেলার পাঁচটি উপজেলার নদীর তীরবর্তী গ্রাম। তবে নদীপাড়ের মানুষ ত্রাণ নয়, তিস্তা নদী খনন করে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের দাবি জানিয়েছেন। যাতে প্রতিবছরের কষ্টে অর্জিত সম্পদ নদীভাঙনে বিনষ্ট না হয়। স্থায়ীভাবে বসবাসের ঠিকানা চান তারা। এজন্য প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত তিস্তা মহাপরিকল্পনার দ্রুত বাস্তবায়ন চান তিস্তাপাড়ের মানুষ।
বুধবার (১০ জুলাই) সদর উপজেলার খুনিয়াগাছ ইউনিয়নে ভাঙনকবলিত এলাকা পরিদর্শন করেন লালমনিরহাট ৩ আসনের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট মতিয়ার রহমান ও সদর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান সুজন। এ সময় তারা ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ করেন।
লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ উল্ল্যাহ বলেন, নদী ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করতে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের বলা হয়েছে। তারা তালিকা করে পাঠালে এবং বরাদ্দ এলে তাদের পুনর্বাসনে ঢেউটিন ও নগদ অর্থ দেওয়া হবে।