ঝিকরগাছা’ যশোর জেলার অন্যতম একটি উপজেলা শহর। যশোর শহর থেকে ১২ কিলোমিটার দক্ষিণে এর অবস্থান। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পরও তাৎক্ষণিক ভাবে রাজধানী ঢাকার সঙ্গে এই অঞ্চলের কোনো যোগাযোগ ছিল না। ঢাকায় কি ঘটছে সে খবর এখানকার লোকজন জানতে পারতো না। কোলকাতা ছিল এখান থেকে নিকটবর্তী এবং সরাসরি রেল যোগাযোগ অব্যাহত ছিল।
ঝিকরগাছায় একটা রেলস্টেশন ছিল। দুপুরে কোলকাতার শিয়ালদহথেকে একটা টেন আসতো। সেই ট্রেনে করে শ্যামাপদ চক্রবর্তী নামে এক ব্যক্তি কয়েক বান্ডিল খবরের কাগজ নিয়ে আসতেন। ঝিকরগাছা বাজারে তার একটি দোকান ছিল। তিনি ছিলেন বেশ কয়েকটি সংবাদপত্রের এজেন্ট। কোন কিছু জানার জন্য এ অঞ্চলের লোকজন কোলকাতা থেকে প্রকাশিত সংবাদপত্রের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। সে সময় এ অঞ্চলে অর্থনৈতিক টানাপড়েন দেখা দেয়। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য কন্ট্রোলের দোকানের মাধ্যমে বিক্রি হতো। কেরোসিন এবং পেট্রোলের সংকট ছিলো চরমে। ভারত থেকে চোরাপথে চোরাকারবারিরা চরকা মার্কা থান কাপড় ও মাড়ি আমদানি করতো। এ সময় খাদ্যদ্রব্যেরও ব্যাপক সংকট দেখা দিয়েছিল।
রাজধানী ঢাকা থেকে আপাত বিচ্ছিন্ন হয়েও ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো ঝিকরগাছার মানুষও স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেছিল। এ-আন্দোলন রাজনৈতিকভাবে পরিচালিত হয়নি। মূলত এটি ছিল ছাত্র আন্দোলন। তৎকালীন সময়ে ঝিকরগাছায় কোন কলেজ ছিল না। তাই এ আন্দোলনে যারা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাদের অধিকাংশই ছিলেন উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র।
১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঝিকরগাছার উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ের ছাত্ররা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে আন্দোলন গড়ে তোলেন। সে সময় বিদ্যালয়ে ছাত্র সংখ্যা ছিল খুব সীমিত। ৬ষ্ঠ থেকে ১০ম শ্রেণি পর্যন্ত সর্বমোট ছাত্র সংখ্যা দেড়শ’র বেশি হবে না। তৎকালীন সময়ে এটাই ছিল কোন বিদ্যালয়ের সর্বাধিক ছাত্র সংখ্যা। ২০ ফেব্রুয়ারি সকাল ৯.৩০ মিনিটে নবম ও দশম শ্রেণির ছাত্ররা বিদ্যালয়ের প্রবেশ পথে দাঁড়িয়ে জটলা তৈরি করে। তারা ফিসফিস করে আলোচনা করে, আজ আর কেউ ক্লাস করবে না এবং সকল ছাত্রকে ডেকে নিয়ে এখান থেকেই মিছিল বের করবে। নিচের ক্লাসের ছাত্ররা বিদ্যালয়ের মধ্যে ঢুকে গেল। একটু পরে স্কুলের ঘণ্টা বাজলে শিক্ষকরা শ্রেণিকক্ষে ঢুকে নাম ডাকা শুরু করবেন। কয়েকজন শিক্ষক তখন বিদ্যালয়ের সামনে দাঁড়িয়ে ছাত্রদের গতিবিধি লক্ষ্য করছিলেন।
বিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রধান শিক্ষক ছিলেন জনাব মো. আব্দুল বাকী। তিনি তখনও বিদ্যালয়ে এসে পৌঁছাননি। হোসেনউদ্দীন হোসেন ও মোস্তফা ফারুক মোহাম্মাদের মতো নিচের ক্লাসের ছাত্ররা চুপচাপ যার যার ক্লাসের দিকে যাচ্ছিলেন। এমন সময় উপরের ক্লাসের কয়েকজন ছাত্র তাদের ক্লাস না করে বাইরে চলে আসতে বললেন। তাদের কথা শুনে নিচের ক্লাসের ছাত্ররা ক্লাসে ঢুকবে না মিছিলে যাবেন এই নিয়ে দ্বিধায় পড়ে গেলন। তাঁরা প্রতিটি ক্লাস থেকে ছাত্রদের বাইরে বের করে এনে বিদ্যালয়ের প্রবেশ পথের সামনে জড়ো হলেন। তখন স্কুলের একজন ছাত্র যশোর মাইকেল মধুসূদন কলেজ থেকে আগত মো. মহসীন আলীসহ আরও কয়েক জন ছাত্রনেতাকে সকলের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন।
জেলা শহর থেকে আগত একজন ছাত্রনেতা সকলের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘বন্ধুরা আমার, তোমরা কি জানো আজ পূর্ব বাংলায় কি ঘটনা ঘটছে? ছাত্ররা সমস্বরে উত্তর দিলেন, তারা কিছুই জানেন না। ছাত্রনেতা হাত উঁচু করে বললেন, ‘তোমরা কি শোনোনি, আমাদের মুখের ভাষা কেড়ে নেওয়া হচ্ছে?’ ছাত্ররা বললেন, না, তারা জানেন না। উনি বললেন, ‘ইংরেজ শাসকরা চলে গেছে ৪৭ সালে। আমরা ছিলাম তাদের গোলাম। কেউ কেউ বলে আমরা না কি স্বাধীন হয়েছি। পাক পিবত্র একটা ভূখণ্ড পেয়েছি। এখন এই নব্যশাসকরা আমাদের গলা চেপে ধরেছে। আমরা আমাদের মাতৃভাষায় কথা বলতে পারব না। ওরা বলেছে, এই ভাষা মুসলমানের নয়। এই ভাষার পরিবর্তে ওরা আমাদের ওপরে উর্দু ভাষা চাপিয়ে দিতে চায়। এটা আমরা কখনো মেনে নেবে না। এর বিরুদ্ধে আমরা তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি। পূর্ব বাংলার রাজধানী ঢাকা শহরে কয়েক মাসব্যাপী ছাত্ররা আন্দোলন করছেন। আমরাও তাদের ডাকে সাড়া দিয়ে আন্দোলন করছি। বুকের রক্ত দিয়ে আমরা এই ষড়যন্ত্র রুখবো। যতদিন পর্যন্ত আমাদের এই দাবী পূরণ না হবে, ততদিন পর্যন্ত আমরা এই আন্দোলন চালিয়ে যাব’।
পর পর কয়েক জন ছাত্রনেতা বক্তব্য প্রদান করেন। মোজাম্মেল হক ও তবিবর রহমান তাদের মধ্যে অন্যতম। তারপর বক্তব্য শেষে সেখান থেকে মিছিল শুরু হয়। একদল পুলিশ থানা থেকে এসে রাস্তায় দাঁড়ালেন। ছাত্ররা বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ঘনঘন স্লোগান দিতে থাকেন, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, আমার ভাষা, তোমার ভাষা, বাংলা মোদের মাতৃভাষা; রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।’ স্লোগান দিতে দিতে মিছিলটি বাজারের দিকে এগিয়ে যেতে লাগল। পুলিশও মিছলকারীদের অনুসরণ করতে লাগল ।
পুরো বাজার প্রদক্ষিণ শেষে মিছিলকারীরা বিদ্যালয়ের সামনে এসে দাঁড়ালেন। ছাত্র নেতারা আবার সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখলেন। তারা বললেন, ‘আমাদের এই ন্যায়সঙ্গত দাবি সরকার যতদিন মেনে না নেবে, ততদিন আমরা লাগাতার আন্দোলন চালিয়ে যাব’। ছাত্ররা বজ্রকণ্ঠে আওয়াজ তুললেন, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, আমার ভাষা, তোমার ভাষা, বাংলা মোদের মাতৃভাষা; রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।’ স্থানীয় মুসলিম লীগের প্রতিক্রিয়াশীল নেতারা এই ছাত্র আন্দোলনের বিরুদ্ধে নানা রকম মন্তব্য করতে লাগলেন। তারা প্রধান শিক্ষককে ভবিষ্যতে ছাত্ররা মিছিলে অংশ নিলে তাদের বিরুদ্ধে শান্তি মূলক ব্যবস্থা গ্রহণের পরামর্শ দিলেন। কিন্তু কোন প্রকার ভয়ভীতি ছাত্রদের দমিয়ে রাখতে পারলো না। তারা তাদের দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তে অটল রইলেন।
পরদিন ২১ ফেব্রুয়ারি সকালে ছাত্ররা বিদ্যালয়ের মধ্যে প্রবেশ না করে প্রবেশ পথের সামনে এসে দাঁড়ালেন। ছাত্র নেতৃবৃন্দ আগে থেকেই সেখানে অবস্থান করছিলেন। সবাই একত্র হলে সেখান থেকে মিছিল শুরু হল। সেদিন আর যশোর থেকে কোন ছাত্রনেতা আসেননি। তবিবর রহমান, মোজাম্মেল হক, চৌধুরী হাবিবুর রহমান, মোস্তফা আনোয়ার মোহাম্মাদ, বজলা রহমান, রমজান আলী (হাই মাদ্রাসা), মোস্তফা আনোয়ার হোসেন, আনসার আলী, নূর বক্স, লক্ষী নারায়ণ চক্রবর্তী, গোপাল চন্দ্র সেন, আফসার আলী, কামাল আহমেদ, গোলাম রব্বানী, রমজান আলী, মোস্তফা আহমদসহ অনেকে বিদ্যালয়ের ওপরের ক্লাসের ছাত্ররা মিছিলের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। বয়স্ক ছাত্ররা মিছিলের অগ্রভাগে এসে দাঁড়ালেন। মিছিলটি বিদ্যালয় অতিক্রম করে যশোর রোডে এসে উপস্থিত হলে রাস্তার দুপাশে যারা দাঁড়িয়ে ছিলেন, তারাও মিছিলে অংশগ্রহণ করলেন। দেখতে দেখতে মিছিলটি বিশাল একটি গণসমুদ্রে পরিণত হল। পুলিশ রাস্তায় দাঁড়িয়ে মিছিলের গতিবিধি লক্ষ্য করতে লাগল। সেদিন শুধু বাজার প্রদক্ষিণ নয়, কপোতাক্ষের ব্রিজ পার হয়ে থানার মোড় ঘুরে যে পথে গিয়েছিল সেই পথেই স্লোগান দিতে দিতে মিছিলটা অবশেষে বিদ্যালয়ের সামনে এসে থেমে গেলো। সেদিনই পুলিশ মিছিলে গুলি চালিয়ে ছাত্রদের রক্তে ঢাকার রাজপথ রঞ্জিত করেছিল। কিন্তু ঝিকরগাছার ভাষা সংগ্রামীরা এখবর পেয়েছিল অনেক দেরিতে।