২০০ বছরের ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে বয়ে চলছে ঢাকা। আর ঐতিহ্য হিসেবে প্রতি বছরের ১৪ জানুয়ারি (রোববার) পুরান ঢাকায় উদযাপন হয় পৌষ সংক্রান্তি, যা সাকরাইন বা ঘুড়ি ওড়ানো উৎসব নামে পরিচিত।এ উৎসব যুগ যুগ ধরে বহন করে চলছে ঢাকাবাসী। বাংলা পৌষ মাসের শেষ ও মাঘ মাসের শুরুতে ঐতিহ্যবাহী এ ঘুড়ি উৎসবের আয়োজন করে পুরান ঢাকাবাসী।
এজন্য বিভিন্ন বয়সের তরুণ-তরুণীরা ঘুড়ি নাটাই হাতে বেরিয়ে আসছে, কেউবা আবার ছুটছে কিনতে। মহল্লার দোকানিরা ব্যস্ত সময় পার করছেন। ছোট-বড় হরেক রকমের ঘুড়ির পসরা সাজিয়ে বসে আছে দোকানিরা। ফলে জমে উঠেছে ঘুড়ি-নাটাই বিক্রি। দিনভর ঘুড়ি উড়িয়ে সন্ধ্যায় বর্ণিল আতশবাজি আর রং-বেরঙের ফানুস উড়িয়ে সাকরাইন উৎসবকে আনন্দঘন করে তোলে পুরান ঢাকাবাসী।
শনিবার (১৩ জানুয়ারি) পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, পুরান ঢাকার অলিগলিতে উৎসবের আমেজ। আকাশ ছেয়ে গেছে হরেক রকমের ঘুড়িতে। লাল, নীল, হলুদ— ঘুড়ি উড়িয়ে চলছে খেলা। এতে যোগ দিয়েছে শিশু-কিশোর, যুবক-বৃদ্ধ নানা বয়সের মানুষ। তাই পুরান ঢাকার অলিগলিতে ঘুড়ি-নাটাই বিক্রির ধুমও পড়েছে। এসব এলাকায় প্রবেশ করতেই দেখা মিলবে বিভিন্ন বয়সের তরুণ-তরুণীরা ঘুড়ি নাটাই হাতে বেরিয়ে আসছে, কেউবা আবার ছুটছে কিনতে। মহল্লার দোকানিরা ব্যস্ত সময় পার করছেন। ছোট-বড় হরেক রকমের ঘুড়ির পসরা সাজিয়ে বসে আছে দোকানিরা। ১০ টাকা থেকে ২০০ টাকায় মিলবে সাধারণ ঘুড়ি। আর চায়না বা উন্নত মানের ঘুড়ি মিলবে ২০০ থেকে দুই হাজার টাকায়। এজন্য ঘুড়ি তৈরির কারখানায় বাড়ে ব্যস্ততা। প্রতিদিন হাজারো ঘুড়ি বিক্রি হয় পুরান ঢাকার দোকানগুলোতে।
সাকরাইনের ঘুড়ি তৈরিতে রয়েছে শৈল্পিক নিদর্শন। সঠিক মাপে ঘুড়ি তৈরি করতে না পারলে ঘুড়ি আকাশের নীল রং ছুতে পারবে না। এজন্য বাহারি রঙের ঘুড়ি তৈরি করা হয় সাকরাইন উৎসবে। বাহারি রঙের কাগজ, পলিব্যাগ ও বাঁশের অংশবিশেষ দিয়ে তৈরি হয় এসব ঘুড়ি। সেগুলোর মধ্যে গোয়াদার, চোকদার, মাসদার, গরুদান, লেজলম্বা, চারভুয়াদার, পানদার, লেনঠনদার, গায়েল ঘুড়িগুলো অন্যতম। একই সঙ্গে থাকে বাহারি রঙের নাটাই। এছাড়া নাটাই ও ঘুড়িতে সংযোগ করা হয় বাহারি রঙের সুতা। এসব নাটাই মিলবে ৫০০ থেকে তিন হাজার টাকার মধ্যে। সেসব সুতার মধ্যে রক সুতা, ডাবল ড্রাগন, কিংকোবরা, ক্লাক ডেবিল, ব্লাক গান, ডাবল গান, সম্রাট, ডাবল ব্লেট, মানজা, বর্ধমান, লালগান ও টাইগার অন্যতম।
এদিকে পৌষ সংক্রান্তি ও সাকরাইন উপলক্ষে শনিবার ঘুড়ি র্যালির আয়োজন করেছে বাংলাদেশ ঘুড়ি ফেডারেশন। সংগঠনের সহ-সভাপতি আব্দুল বারেক সোনা মিয়া জানান, সকাল সাড়ে ১১টায় হাজারিবাগ পার্কে ঘুড়ি র্যালি হবে। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন সাবেক রাষ্ট্রদূত ও সচিব ইনাম আহমেদ চৌধুরী।
ঢাকা কলেজের ছাত্র আরিফুল হক ঘুড়ি কিনতে শাঁখারীবাজার এসেছেন। রং-বেরঙের ঘুড়ি কিনে ফিরছেন বাসায়। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, পুরান ঢাকায় ঘুড়ি উড়ানোর উৎসব কবে শুরু হয়েছে তিনি নিজেই জানেন না। জন্মের পর থেকেই দেখছেন এ উৎসব। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ছড়িয়ে গেছে সাকরাইনের ঘুড়ির উৎসব। তিনি এক সময় তার বাবার হাত ধরে ঘুড়ি কিনতে এসেছিলেন। আজকে নিজেই এসেছেন ভবিষ্যতে ছেলেকে নিয়ে আসবে বলে আশা ব্যাক্ত করে আরিফুল বলেন, আসলে এ উৎসব জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবার উৎসব। এটা ঢাকার ঐতিহ্য যা শতকের পর শতক চলবে।
ছেলেকে নিয়ে ঘুড়ি ও নাটাই কিনতে গেন্ডারিয়া থেকে শাঁখারীবাজার এসেছেন শুভ। তিনি বলেন, ছেলেকে নিয়ে ঘুড়ি-নাটাই কিনতে এসেছি। ১৫০টা ঘুড়ি ও ১০টি নাটাই কিনে নিয়ে যাচ্ছি। আগামীকাল সাকরাইন বাসার ছাদে ছোট খাটো অনুষ্ঠান হবে। বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয় পরিজনরা মিলে ঘুড়ি উড়াবো। এদিন আমাদের কাছে প্রাণের উৎসবে পরিণত হবে। সারাদিন ঘড়ি উড়িয়ে রাতে নানা রকমের পিঠা, পুলিসহ বিভিন্ন ধরনের খাওয়া দাওয়া হবে।
নারিন্দার বাসিন্দা রহিম মিয়া ঢাকায় এসেছেন প্রায় ২৫ বছর। তিনি বলেন, যখন গ্রামে ছিলাম তখন শখে ঘুড়ি উড়িয়েছি। এমন অনুষ্ঠান আয়োজন করে ঘুড়ি উড়ানো হয়নি। ঢাকাতে আসার পর এখন প্রতিবছর আয়োজন করে একদিন ঘুড়ি উড়িয়ে থাকি। সারাদিন আনন্দ-উল্লাস করি। তাই ঘুড়ি ও নাটাই কিনেছি। এখানে বিভিন্ন ধরনের ঘুড়ি ও নাটাই বিক্রি হয়, কিছু বাঁশের আবার কিছু আছে স্টিলের। ছোট নাটাই ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা, মাঝারি ধরনের ২শ’ থেকে আড়াইশো এবং বড় নাটাই ৩শ’ থেকে ৭শ’ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
শাঁখারীবাজার মাতাশ্রী স্টোরে নাটাই-ঘুড়ি বিক্রি করছেন রঞ্জন ধর। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, এবছর ঘুড়ি ও নাটাই বেশি বিক্রি হচ্ছে। তবে দাম আগের তুলনায় একটু বাড়লেও ক্রেতার সংকট নেই। কয়েকদিন ধরে ক্রেতার ভিড় সামলাতে হিমশিম খাচ্ছি। কাগজের দাম ও কারিগরদের পারিশ্রমিক বেড়ে যাওয়ায় ঘুড়ি-নাটাইয়ের দামও একটু বেড়েছে।
এবিষয়ে পুরান ঢাকার ৪৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. আরিফ হোসেন ছোটন বাংলানিউজকে বলেন, সাকরাইন উৎসব পুরান ঢাকার ঐতিহ্য। কালের পরিক্রমায় এ ঐতিহ্য পুরান ঢাকার গণ্ডি ছাড়িয়ে দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু যান্ত্রিক জীবনের বাস্তবতায় আমরা অনেকেই ভুলতে বসেছি, সাকরাইন উৎসব আমাদের ঐতিহ্যের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এদিন পুরান ঢাকার বাড়িগুলোর ছাদ যেন বিনোদন কেন্দ্রে পরিণত হয়। যেকেউ ঘুড়ি নিয়ে এ উৎসবে অংশ নিতে পারবেন। এ উৎসব সবার জন্য উন্মুক্ত, সার্বজনীন।
জানা গেছে, উৎপত্তিগত জায়গায় সংস্কৃত শব্দ সংক্রান্তি ঢাকাইয়া অপভ্রংশে সাকরাইন শব্দের রূপ নিয়েছে। ঢাকার শাঁখারীবাজার, তাঁতীবাজার, গোয়ালনগর, লক্ষ্মীবাজার, সূত্রাপুর, মিলব্যারাক, নারিন্দা, নবাবপুর, ওয়ারি, গেণ্ডারিয়া, পোস্তগোলা, হাজারীবাগ, লালবাগ ও এর আশপাশ এলাকাগুলোয় বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্যে ছোট-বড় সবাই মেতে ওঠে এ উৎসবে। দিনভর ঘুড়ি উড়িয়ে সন্ধ্যায় বিভিন্ন আয়োজনে সবাই আনন্দে মেতে ওঠেন।
এসব বাহারি ঘুড়ির মালিককে নিয়ে আয়োজন করা হয় ঘুড়ি উড়ানোর প্রতিযোগিতা। বাসার ছাদে এসব প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। প্রতিযোগীদের মধ্যে চ্যাম্পিয়ন ও রানারআপ নির্ধারণ করা হয়। ঘুড়ি উড়ানোর প্রতিযোগিতায় মূলত যে যত বেশি উড়ন্ত ঘুড়ির সুতা দিয়ে অন্য ঘুড়ি কাটতে পারবে এবং শেষ পর্যন্ত যার ঘুড়ি উড়বে সে হবে চ্যাম্পিয়ন।
বিজয়ীদের মধ্যে পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানও হয় জাঁকালো। এদিন পিঠা, পায়েসসহ নানা রকমের খাবারের আয়োজন থাকে এ অনুষ্ঠানে। উৎসব উদযাপনের রাতে কিশোর-যুবকরা মুখে কেরোসিন নিয়ে আগুনের লেলিহান রাশি তৈরি করে, যা সবার মধ্যে উচ্ছ্বাস আবহ নিয়ে আসে।
প্রসঙ্গত, প্রাচীন উৎসবের মধ্যে পুরান ঢাকার সাকরাইন অন্যতম। এটা গোটা দেশে উদযাপন না হলেও সাকরাইন ঐক্য এবং বন্ধুত্বের প্রতীক হিসেবে দেখা হয়। শুধু ঢাকাতেই নয়; দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে পৌষ সংক্রান্তির এ উৎসব পালনের রীতি চালু রয়েছে। নেপালে একে বলে মাঘি, থাইল্যান্ডে সংক্রান, লাওসে পিমালাও, মিয়ানমারে থিং ইয়ান, কম্বোডিয়ায় মহাসংক্রান ও ভারতে মকর সংক্রান্তি।