ফরিদপুর-৩ আসন
মঙ্গলবার সকাল ১১টা। ফরিদপুর শহরের পুরাতন বাসস্ট্যান্ড এলাকায় গণসংযোগ করছিলেন ফরিদপুর-৩ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী এ কে আজাদ।সর্ব সাধারণের সঙ্গে হাত মিলিয়ে কুশলাদি বিনিময় করেন তিনি। এ সময় অধিকাংশ সাধারণ ভোটারদের সাফ কথা- ‘নির্ভয়ে ভোট কেন্দ্রে যেতে চাই। যাকে খুশি তাকে ভোট দেওয়ার পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারলে ঈগলে বিজয় সুনিশ্চিত। ’
ফরিদপুরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরেও দেখা গেল-সর্বত্র ভোটের আমেজ। চায়ের দোকানেও নির্বাচনী তুমুল আড্ডা। আনাচে-কানাচে ঈগল ও নৌকার পোস্টার। তবে অনেকের মধ্যে চাপা আতঙ্ক। একের পর এক শামীম হকের ক্যাডাররা ঈগল প্রতীকের কর্মী-সমর্থকদের ওপর হামলা চালাচ্ছেন। সাধারণ ভোটারদের মধ্যে ভয় ধরাতে চোরাগোপ্তা হামলার কৌশল নিয়েছে শামীমের অনুসারীরা। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর স্থানীয় কর্মকর্তারাও বলছেন, দলবদ্ধ হয়ে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বের হয়ে আকস্মিক স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকদের ওপর হামলা করে গা-ঢাকা দিচ্ছে কয়েকটি গ্রুপ। এমন একাধিক সশস্ত্র চক্রকে নজরদারিতে রাখা হচ্ছে।
সর্বশেষ মঙ্গলবার (২৬ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় পৌরসভার ১৪ নম্বর ওয়ার্ডে এ কে আজাদের নির্বাচনী অফিসে বর্বর হামলা চালানো হয়। এ সময় পাঁচজনকে কুপিয়ে জখম করা হয়েছে। তার মধ্যে আবদুর রহমান নামে একজনের অবস্থা সংকটাপন্ন। এ নিয়ে আনুষ্ঠানিক নির্বাচনী প্রচারণা শুরুর পর গত ৯ দিনে ১৯টি হামলার ঘটনা ঘটেছে। এতে জড়িতরা এখনও গ্রেপ্তার হয়নি।
পুলিশ ও র্যাব বলছে, হামলায় জড়িত যাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে তাদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে। ঈশান-গোপালপুরের চেয়ারম্যান শহিদুল ইসলাম মজনু, সম্রাট, মোবারকসহ বেশ কয়েকজনকে খুঁজছে একাধিক সংস্থা।
পুলিশ মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন বলেন, যেখানে হামলা-সংঘর্ষ হচ্ছে সেখানেই দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে। ফরিদপুর- ৩ আসনে ঘটনার তদন্ত হচ্ছে। জড়িতরা ছাড় পাবে না।
ঢাকা রেঞ্জের উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) সৈয়দ নুরুল ইসলাম বলেন, নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ যারা বিঘ্নিত করছে, তাদের বিন্দুমাত্র ছাড় দেওয়া হবে না। যত ঘটনা ঘটছে, সবগুলোর তদন্ত চলছে। আসামিদের ধরা হবে।
ফরিদপুরের রিটার্নিং কর্মকর্তা ও জেলা প্রশাসক (ডিসি) মো. কামরুল আহসান তালুকদার বলেন, হামলা-সংঘর্ষ এবং ভাঙচুরের বেশ কয়েকটি ঘটনা ফরিদপুর- ৩ আসনে ঘটেছে। সব ঘটনা আমাদের নজরে এসেছে। জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছি। মঙ্গলবারের ঘটনায় স্বতন্ত্র প্রার্থীর ক্যাম্পের হামলা জড়িতদের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তার করতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
অন্য এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, শুধু হামলা ও সংঘর্ষই আচরণবিধির লঙ্ঘন নয়। নিয়ম না মেনে যত্রতত্র ক্যাম্প বসানো হয়েছে। দ্রুত এসব অপসারণের জন্য নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের বলা হয়েছে।
প্রশাসনের একজন কর্মকর্তার ভাষ্য, মঙ্গলবার ফরিদপুরের এসপি মো. শাহজাহানকে বদলি করে ঢাকা মহানগর পুলিশে পদায়ন করা হয়েছে। আজ-কালের মধ্যে ডিএমপির উত্তরা বিভাগের ডিসি মোর্শেদ আলম নতুন এসপি হিসেবে যোগদান করবেন। এসপি রদবদলের খবরটি গতকাল ফরিদপুরে ছিল ‘টক অব দ্যা সিটি’। ওই কর্মকর্তার ভাষ্য, নতুন এসপি দায়িত্ব নেওয়ার পর দ্রুত পরিস্থিতি শান্ত হয়ে আসবে।
গতকাল সন্ধ্যায় ১৪ নম্বর ওয়ার্ডে এ কে আজাদের নির্বাচনী ক্যাম্পে সশস্ত্র হামলা চালায় শামীম হকের সমর্থকরা। এতে স্বতন্ত্র প্রার্থীর নির্বাচন পরিচালনা কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক আবদুর রহমানসহ পাঁচজন আহত হন। সংকটাপন্ন অবস্থায় তাকে ফরিদপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শী আশরাফ হোসেন জানান, অন্যান্য দিনের মতো মঙ্গলবারও তারা ক্যাম্পে বসে বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ করছিলেন। এ সময় পৌর কাউন্সিলর মোবারক খলিফা, আতিয়ার শেখের নেতৃত্বে অন্তত ২০০ ব্যক্তি নৌকার স্লোগান দিয়ে ঈগল প্রতীকের ক্যাম্পে অতর্কিত হামলা চালায়। তারা রামদা দিয়ে আবদুর রহমানের মাথায় আঘাত করেন। রক্তে তার জামা-কাপড় ভিজে যায়। এরপর মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়- এ কে আজাদের নির্বাচনী ক্যাম্পের ফ্লোরে ছোপ ছোপ তাজা রক্ত। এই ঘটনার পর র্যাব-পুলিশের পৃথক দু’টি টিম ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে।
আবদুর রহমানের স্ত্রী পারভীন বেগম বলেন, ‘আমার স্বামী একজন নির্বিবাদী লোক। শুধু ঈগল প্রতীকের নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নেওয়ায় হামলা করা হলো। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে জড়িতদের গ্রেপ্তার করা হোক। এটা না হলে তারা অন্য কারও ওপরও একই কায়দায় হামলা করবে। ’এছাড়া সোমবার রাতে ফরিদপুর শহরের টেপাখোলা থেকে ফেরার পথে এ কে আজাদের তিন সমর্থক হৃদয়, জিহান ও মাজহারুলকে মারধর করা হয়। ওই সময় তাদের মোবাইল ভেঙে ফেলা হয়। জোরপূর্বক ভিডিও করে তাদের দিয়ে বলানো হয়- ‘আমরা শামীম হকের পোস্টার ছিঁড়েছি। ’
ফরিদপুর- ৩ আসনের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়- নৌকার প্রার্থী শামীম হকে নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই যেখানে খুশি সেখানে ক্যাম্প তৈরি করেছেন। জেলা শহরের ব্যস্ত এলাকায় ফুটপাত দখল করেও বানানো হয়েছে তার অফিস। পুরাতন বাসস্ট্যান্ডের সামনে ও ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ সংলগ্ন রাস্তার ওপর নির্বাচনী ক্যাম্প তৈরি করা হয়। এছাড়া শহরের অনেক এলাকায় বৈদ্যুতিক খুঁটিতে বড় বড় পোস্টার সাটিয়েছেন তার সমর্থকরা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসব নির্বাচনী আচরণবিধির স্পষ্ট ব্যত্যয়।
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একজন কর্মকর্তা জানান, নির্বাচন ঘিরে বাইরে কোনো সশস্ত্র ক্যাডার ‘ভাড়াটে’ হিসেবে আনা হয়েছে কি-না তা নিয়ে গোয়েন্দারা কাজ করছেন। তবে একাধিক মামলা মাথায় নিয়ে যারা দীর্ঘদিন এলাকা ছাড়া ছিলেন তাদের মধ্যে অনেকে মাঠ দাপাচ্ছেন।
এই আসনের প্রায় প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও ঝামেলা হচ্ছে নৌকা আর ঈগল প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে। এমন পরিস্থিতিতে ভোটাররাও একটা অজানা আতঙ্কে রয়েছেন। গতকাল ফরিদপুর শহরের তেতুলতলা, খাবাসপুর, আলীপুর, টেপাখোলা, পুরান বাসস্ট্যান্ড এলাকায় ঘুরে লোকজনের সঙ্গে কথা বলেও সেই আতঙ্কের আভাস মিলল। তারা বলছেন, পরিস্থিতি দিন দিন জটিল হয়ে উঠছে ফরিদপুরের সদর আসনে।
গতকাল নতুন বাসস্ট্যান্ড এলাকায় জনসংযোগ করেন স্বতন্ত্র প্রার্থী এ কে আজাদ। পরে তিনি পথ সভায় বলেন, আওয়ামী লীগ থেকে বলা হয়েছে স্বতন্ত্র প্রার্থী এবং দলীয় প্রার্থী সমান অধিকার পাবে। পার্টির লোকজনও তার ইচ্ছেমতো নৌকার পক্ষে বা স্বতন্ত্রের পক্ষে কাজ করতে পারে- দলীয় বাধা নেই। এই আশ্বাসে নির্বাচনে এসেছি। কিন্তু অনেকেই এটা সহ্য করতে পারছে না।
নৌকার প্রার্থীর নাম উল্লেখ না করে তিনি বলেন, তারা এমন কিছু লোককে, সন্ত্রাসী লোককে এখানে সম্পৃক্ত করেছে, তাদের নাম বলতে আমি নিজেও ভয় পাই। সন্ত্রাসীরা এখন আমার কর্মীদের ওপর হামলা চালাচ্ছে, নির্বাচনী ক্যাম্প ভাঙচুর করছে।
এ কে আজাদের সমর্থকরা বলছেন, নানা হামলা ও হুমকির ঘটনায় এ পর্যন্ত ১৩টি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন তারা। মামলা করা হয়েছে ১৩টি। পুলিশ কিছু চুনোপুঁটিকে গ্রেপ্তার করলেও চিহ্নিতরা প্রকাশ্যেই মিছিল-মিটিং করে চলেছে। গতকাল মঙ্গলবারও পৌরসভার ১৪ নম্বর ওয়ার্ডে নির্বাচনী ক্যাম্পে হামলা হয়। কুপিয়ে ঈগল প্রতীকের চার সমর্থককে আহত করা হয়। তাদের মধ্যে আবদুর রহমান নামে একজনের অবস্থা সংকটাপন্ন। তাদের অভিযোগ, ঈগল ঠেকাতে এখানে নৌকার সমর্থকরা চোরাগোপ্তা হামলা শুরু করেছে।
স্বতন্ত্র প্রার্থীর বক্তব্যের বিষয়ে জানতে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শামীম হকের মোবাইলফোনে কল করা হয়। তবে এ ব্যাপারে তার কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
নির্বাচন অফিস থেকে জানা গেছে, ফরিদপুর-৩ আসনে মোট ভোটার সংখ্যা ৪ লাখ ৪ হাজার ৩১১ জন। পুরুষ ২ লাখ ২হাজার ৭৭৫ জন এবং নারী ভোটার ২ লাখ ১ হাজার ৫৩৩। তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার রয়েছেন তিনজন। এই আসনে নৌকা ও স্বতন্ত্রের ঈগল প্রতীক ছাড়াও জাতীয় পার্টিসহ (জাপা) আরও তিন প্রার্থী রয়েছেন। যদিও তারা আলোচনায় নেই। এই আসনে ১৯৯১ সাল থেকে ২০০১ সালের অষ্টম জাতীয় নির্বাচন পর্যন্ত বিএনপির চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফ এমপি ছিলেন। এরপর নবম সংসদ থেকে বর্তমান একাদশ সংসদ পর্যন্ত এমপি রয়েছেন খন্দকার মোশাররফ হোসেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৬৩০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৭, ২০২৩