বাংলাদেশ যেন ভারতের কাছ থেকে হঠাৎ স্বাধীনতা লাভকারী একটি দেশ। যেন আরও ২৮টি প্রদেশের মতো এতদিন বাংলাদেশ ভারতের অঙ্গরাজ্য ছিল।গত বছরের ৫ আগস্ট স্বাধীন হয়েছে। বাংলাদেশের অভূতপূর্ব বিপ্লব পরবর্তী সময়ে ভারতীয় সাংবাদিকদের কথাবার্তা, ভারতীয় সরকারের ভূমিকা, সে দেশের মানুষের আক্ষেপ কি তাই প্রমাণ করছে না? প্রমাণ করছে শেখ হাসিনা কার্যত ভারতের বাংলাদেশ প্রদেশের একজন মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। এ বিষয়ে নতুন পুরনো অনেক তথ্য হাজির করা যায়। তবে তার আগে যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্প ও মোদির বৈঠক শেষে ভারতীয় এক সাংবাদিকের প্রশ্ন ও তার উত্তর পর্যালোচনা এখন জরুরি।
গেল ১৩ ফেব্রুয়ারি হোয়াইট হাউসের ওভাল অফিসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের বৈঠক হয়। বৈঠক শেষে ভারতীয় এক সাংবাদিক জানতে চান, ‘আমরা জানি বাংলাদেশে ক্ষমতার পালাবদলে বাইডেন প্রশাসনের সময় মার্কিন ডিপ স্টেট জড়িত ছিল। সম্প্রতি মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে জুনিয়র সরোসের (জর্জ সরোসের ছেলে) বৈঠকেও তা প্রমাণিত। তো বাংলাদেশ নিয়ে আপনি কী বলবেন?’
জবাবে ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন, ‘না, আমাদের ডিপ স্টেটের এখানে (বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে) কোনো ভূমিকা ছিল না। প্রধানমন্ত্রী (নরেন্দ্র মোদি) এই বিষয়টা নিয়ে বহুদিন ধরে কাজ করছেন। এটা নিয়ে (ভারত) শত বছর ধরে কাজ করছে। বস্তুত আমি এরকমই পড়েছি। ’
তিনি আরও বলেন, ‘কাজেই এটা আমি প্রধানমন্ত্রীর ওপরই ছেড়ে দেব’। এ কথা বলে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প পাশে বসা ভারতের প্রধানমন্ত্রীর দিকে ইঙ্গিত করেন। অর্থাৎ বাংলাদেশ নিয়ে ওই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য তা মোদির ওপর ছেড়ে দেন। এরপর মোদি কী বললেন সেটা ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ। দৃশ্যমান হলো বাংলাদেশ নিয়ে মোদি কোনো কথাই বললেন না। বরং বিষয়টি এড়িয়ে ঝুঁকে গেলেন ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধর প্রসঙ্গে।
বাংলাদেশ প্রসঙ্গ দুই নেতার মধ্যে আলোচনায় আদৌ আসবে কি না, তা নিয়েও সংশয় ছিল। তার কারণ ট্রাম্পের ‘ট্যারিফ যুদ্ধ’! তবে ভারতীয় সাংবাদিকের কারণে বাংলাদেশ ইস্যু নিয়ে কথা বলতেই হলো যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টকে। ভারতীয় সরকারের পাতানো ছকে ওই প্রশ্ন করেছেন বলে মনে করছেন বাংলাদেশের রাজনীতি বিশ্লেষকরা।
বৈঠকের খবরটি প্রকাশিত হয়েছে ভয়েস অব আমেরিকাসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে। একারণে এই বৈঠকের ওই প্রশ্ন নিয়ে বাংলাদেশের জনমনে ট্রাম্পের দেওয়া উত্তর ও মোদির ভূমিকা নিয়ে চারটি প্রশ্ন জেগেছে।
প্রথমত, বাংলাদেশের এই পরিবর্তনে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকার বিষয়টি কেন সামনে আনলেন ভারতীয় সাংবাদিক। দ্বিতীয়ত, এটার মাধ্যমে বাংলাদেশের ছাত্র-জনতার এই বিপ্লবকে কেন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিবাচক অর্থে কৃতিত্ব ও নেতিবাচক অর্থে উসকানি দেখছেন ভারতীয় সাংবাদিক। তৃতীয়ত, স্বাধীন একটি দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের বক্তব্য দেওয়ার প্রেক্ষাপট তৈরি করা—কূটনৈতিক শিষ্টাচারের মধ্যে পড়ে কি না। চুতর্থত, বাংলাদেশের বিষয়ে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী কত বছর ধরে পড়াশোনা করে চলেছেন, সেটাও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট সজাগ রয়েছেন এবং বাংলাদেশের বিষয়গুলো তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রীর ওপর ন্যস্ত করেছেন, এমনটিই ধারণা করছেন ভারতীয় সাংবাদিকরা।
এবার ট্রাম্পের বক্তব্য নিয়ে আলোচনা করা যাক। প্রথমত, এই বিপ্লবের পুরো কৃতিত্ব তিনি বাংলাদেশের জনগণকে দিয়েছেন। নিজের কৃতিত্ব নিতে গিয়ে বাংলাদেশের জনগণকে খাটো করে দেখাননি। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশে ভারতীয় প্রভুত্ব তৈরি ও তার ব্যর্থতার দায়-দায়িত্ব ট্রাম্প মোদিকেই দিয়েছেন। বাংলাদেশ নিয়ে দিল্লির দীর্ঘদিনের গবেষণা ও লোভ-বাসনার কথা ট্রাম্পের অজানা নয়। মূলত ১৯৪৭ সালের দেশ ভাগ ও ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনসহ হাসিনার ১৬ বছরের শাসনামল নিয়ে ভারতের ভূমিকা ওয়াশিংটনের অজানা নয়, সেটাও বুঝিয়ে দিয়েছেন।
যাই হোক, ‘মোদির ওপর বাংলাদেশের দায়িত্ব দিয়েছেন’ বলে ভারতীয় সাংবাদিকরা আত্মতুষ্টিতে ভুগছেন। কিন্তু গভীরভাবে ব্যাখ্যা করলে বোঝা যাচ্ছে যে, অতীতে বাংলাদেশ নিয়ে দিল্লির ভূমিকার কথাটাই তিনি বলেছেন।
মার্কিন প্রেসিডেন্টের বক্তব্য ভারতীয় গণমাধ্যম বেশ ইতিবাচক হিসেবে মূল্যায়ন করেছে। কেননা ট্রাম্পের বক্তব্যকে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো মনে করছে, বাংলাদেশের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা বা দেখভালের দায়িত্ব ভারতের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প।
তাদের এই ধারণা ঠিক নয় বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। কারণ মোদিকে উত্তর দিতে ইশারা দিলেন ট্রাম্প। কিন্তু মোদি এ প্রসঙ্গ এড়িয়ে কোনো উত্তর না দিয়ে চলে গেলেন ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়ে পরবর্তী আলোচনায়। তা থেকেই বোঝা যায়, এখানেও মোদি বিব্রত হয়েছেন।
এখন দেখার বিষয় ট্রাম্পের বক্তব্যকে আমরা কীভাবে নেব। কেননা ট্রাম্প এ ধরনের প্রশ্নে বিরক্ত হয়েছেন বলে প্রতীয়মান হয়েছে। যারা ভিডিও দেখেছেন তাদের কাছে বিষয়টি পরিষ্কার হয়েছে বেশ ব্যাঙ্গাত্মক ভঙ্গিতে মোদিকে উদ্দেশ্য করে বলছেন, ‘উনিতো অনেক বছর ধরে বাংলাদেশ নিয়ে পড়াশোনা করছেন’।
ভারতীয় সাংবাদিক যখন প্রশ্ন করেন তখন তিনি মোদিকে দেখিয়ে দেন। যেন পৃথিবী নামক ভূখণ্ডটির প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আর মোদি এই ভূখণ্ডের প্রধানমন্ত্রী।
বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের সমর্থকদের এই বৈঠক নিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ ছিল চোখে পড়ার মতো। পাশাপাশি মোদির যুক্তরাষ্ট্র সফরকালে সেখানকার আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের অবস্থান ছিল লজ্জাজনক। সেখানে তারা মোদিকে স্বাগত জানিয়ে নানা ধরনের স্লোগান দিয়েছেন। যেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানাচ্ছেন অথবা আওয়ামী লীগ ভারতীয় বিজেপির বাংলাদেশ শাখা। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মনোভাব এই পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের বিনিময়েও যদি হাসিনাকে দেশের প্রধানমন্ত্রী করে দেয় ভারত, তাতেও কোনো আপত্তি নেই তাদের। দেশ ও দেশের সার্বভৌমত্ব নিয়ে তাদের এই অবস্থান নিয়ে আবারও জিজ্ঞাসা তৈরি হয়—আদতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে দলটির যে গৌরবময় ভূমিকা ছিল, তা কি পাকিস্তান ভাঙার ভারতীয় ষড়যন্ত্রের অংশ?
বাংলাদেশ নিয়ে ভারতের ভূমিকা সম্প্রতি খুবই প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। বিশেষত গত ১৬ বছর ধরে আওয়ামী লীগকে নিরঙ্কুশ সমর্থন দিয়ে বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে ধ্বংস করার দায় এখন ভারতের কাঁধে। এ দায় ভারত নিজেই তার কাঁধে নিয়েছে। পালিয়ে যাওয়ার আগে শেখ হাসিনাকে সমর্থন দিয়ে ফ্যাসিস্টে পরিণত করার দায় ভারত এড়িয়ে যেতে পারে না। সে কারণে ওয়ান-ইলেভেনের মাধ্যমে শেখ হাসিনা ক্ষমতাসীন হওয়ার পরপরই রাজধানীর পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহের নামে ৫৭ জন সেনাকর্মকর্তাসহ ৭৪ জন সামরিক বেসামরিক নাগরিক হত্যার জন্য এখন অনেকেই ভারতের দিকে আঙুল তুলছে। বাংলাদেশের সেনাবাহিনীকে দুর্বল করে দিতে ছক করে এই হত্যা মিশন পরিচালনা করা হয় বলে মনে করেন নিহত সেনাকর্মকর্তাদের পরিবারের সদস্যরা। এ নিয়ে কয়েকদফা সংবাদ সম্মেলন করেছেন তাদের স্বজনরা।
এ ছাড়া ২০১৪ সালের নির্বাচনে ১৫৪ আসনে কোনো ভোট ছাড়াই এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। বাকি পদেও ভোটারবিহীন নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে ভারত। ২০১৮ সালে রাতের ভোটে সমর্থন দিয়ে হাসিনাকে আরও বেশি ভারত নির্ভর করে তোলে দেশটি। ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি ভোটের মাধ্যমে শেখ হাসিনাকে চূড়ান্ত স্বৈরশাসকে রূপান্তরিত করে ভারত। এই ষোল বছরের শাসনকালে যত গুম, খুন, আয়নাঘরে নির্যাতন হয়েছে, তার দায় এড়াতে পারে না ভারত। এভাবে ঘৃণা ছড়িয়ে শেখ হাসিনার মতোই ভারতও এদেশের জনগণের ঘৃণা কুড়িয়েছে। এখনও ভারত সেই ভূমিকা থেকে সরে যায়নি। বরং যেন করদরাজ্য হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার কষ্টে নীল হয়ে গেছে উগ্র হিন্দুজাতীয়তাবাদী নরেন্দ্র মোদি সরকার। তাই দেশে বিদেশে বাংলাদেশবিরোধী প্রচারে নেমেছে দেশটি। অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করতেও ছাড়ছে না ভারতীয় মিডিয়া।
মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকা বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ কৃতজ্ঞতাভরে স্মরণ করে থাকে। কিন্তু ভারতের ৫৪ বছরের অত্যাচার, তিস্তা চুক্তি না করে গজলডোবায় ড্যাম দিয়ে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলকে শুষ্ক মৌসুমে শুকিয়ে মারা, পদ্মার পানি প্রত্যাহার, বন্যায় পানি ছেড়ে দেওয়া, ফেলনীসহ সীমান্ত হত্যা, শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের পলাতকদের আশ্রয় দেওয়া নিয়ে জনমনে যে অসন্তোষ—যুক্তরাষ্ট্রে মোদির সফরে সেটা আরও বৃদ্ধি পেল।