আচমকা কেউ অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল, সামনে দাঁড়িয়ে থাকা আপনি কিংকর্তব্যবিমূঢ়। চিকিৎসক খুঁজবেন, হাসপাতালে নেবেন নাকি প্রাথমিক শুশ্রূষা দেবেন, বুঝতে পারছেন না।
অনেকে এ সময় মাথায় পানি ঢালতে থাকে, কেউ পায়ে তেল ঘষে, কেউ নাকে গন্ধ শোঁকায়। আর এসব করতে গিয়ে নষ্ট হয় মূল্যবান সময়।
স্ট্রোক বা হৃৎস্পন্দনজনিত সমস্যায়, এমনকি তড়িতাহত হলে মানুষের হৃৎপিণ্ডের কার্যকারিতা হঠাৎ বন্ধ হয়ে যেতে পারে। ফলে মস্তিষ্কে রক্তপ্রবাহ বন্ধ হয়ে গিয়ে রোগী অজ্ঞান হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় কয়েক মিনিট এভাবে নষ্ট করলেও মস্তিষ্কের স্থায়ী ক্ষতি হয়ে যায়, যা রোগীর মৃত্যুর কারণ পর্যন্ত হতে পারে। অথচ চিকিৎসক না হয়েও কিছু বিশেষ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এ ধরনের রোগীর শ্বাসপ্রশ্বাস ও হৃৎপিণ্ডের কাজ চালিয়ে নেওয়া গেলে জরুরি স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া অবধি রোগীকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব। যে বিশেষ ব্যবস্থায় কৃত্রিমভাবে রোগীর ফুসফুস ও হৃৎপিণ্ডের কাজ সাময়িকভাবে চালু রাখা হয়, তাই হচ্ছে কার্ডিও পালমোনারি রিসাসিটেশন বা সিপিআর।
এটি একধরনের প্রাথমিক চিকিৎসা। উন্নত বিশ্বে সাধারণ জনগণকে এ ব্যাপারে বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হলেও আমাদের দেশে এ বিষয়ে অধিকাংশ মানুষই অজ্ঞ। অথচ সঠিক সময়ে সঠিকভাবে সিপিআরের মাধ্যমে লাইফ সাপোর্ট দেওয়া গেলে হাসপাতালে নিয়ে যথাযথ চিকিৎসাসেবা দেওয়ার আগপর্যন্ত রোগীর শ্বাসপ্রশ্বাস ও হৃদ্যন্ত্রের কাজ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব।
আশপাশের কেউ হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে গেলে প্রথমেই রোগীকে জোরে ডেকে বা নাড়াচাড়া করে দেখতে হবে জ্ঞান আছে কি না। তারপর দেখতে হবে, শ্বাসনালি পরিষ্কার আছে কি না, রোগীর শ্বাসপ্রশ্বাস চলছে কি না, হৃৎস্পন্দন আছে কি না; যদি না থাকে, তাহলে চিকিৎসক ও অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করার পাশাপাশি রোগীকে শক্ত স্থানে চিত করে শুইয়ে টাই বা কাপড়চোপড় আলগা করে সিপিআর শুরু করতে হবে।
সিপিআরে মূল কাজটা হচ্ছে হৃৎপিণ্ডের ওপরে নির্দিষ্ট বিরতিতে চাপ দেওয়া, সেই সঙ্গে মুখে বাতাস প্রবেশ করিয়ে শ্বাসপ্রশ্বাস বজায় রাখা। রোগীর বুকের ঠিক মাঝবরাবর, দুই স্তনবৃন্তের মাঝখানে এক হাতের তালুর ওপরে আরেক হাতের তালু রেখে দুই হাতই একদম সোজা রেখে উল্লম্বভাবে বুকের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে হবে। এমনভাবে চাপ দিতে হবে যাতে বুক পাঁচ থেকে ছয় সেন্টিমিটার দেবে যায়। চাপের সংখ্যা হবে মিনিটে প্রায় ১০০। পরপর ৩০ বার চাপ দেওয়ার পর রোগীর মুখ খানিকটা ওপর দিকে তুলে এক হাতে নাক চেপে ধরে, আরেক হাতে মুখ খানিকটা হাঁ করিয়ে রোগীর মুখের সঙ্গে নিজের মুখ লাগিয়ে বেলুনে ফুঁ দেওয়ার মতো করে জোরে বাতাস প্রবেশ করাতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে, বাতাস প্রবেশ করানোর ফলে রোগীর পেট ফুলে উঠছে কি না। এভাবে দুবার মুখে মুখে শ্বাসপ্রশ্বাস চালিয়ে আবারও বুকে চাপ দিতে হবে ৩০ বার। মুখ দিয়ে কোনো কারণে বাতাস প্রবেশ করানো সম্ভব না হলে নাক দিয়েও করানো যায়। এভাবেই হৃৎপিণ্ডের ওপর চাপ আর কৃত্রিম শ্বাসপ্রশ্বাসের মাধ্যমে সিপিআর চালিয়ে যেতে হবে যতক্ষণ না অ্যাম্বুলেন্স বা জরুরি চিকিৎসা সাহায্য পাওয়া যাচ্ছে।
সিপিআর পদ্ধতি শেখার জন্য কিছু প্রশিক্ষণব্যবস্থা রয়েছে। এ ছাড়া ইউটিউবসহ অন্যান্য ভিজ্যুয়াল মিডিয়ায় ভিডিও দেখেও এ বিষয়ে ধারণা নেওয়া সম্ভব। সিপিআর শুধু হার্ট অ্যাটাক নয়, পানিতে ডোবা বা দুর্ঘটনায় আহত ব্যক্তির ক্ষেত্রেও কাজে আসে। এ ধরনের বিপদে চিকিৎসক বা অ্যাম্বুলেন্সের অপেক্ষা না করে জরুরি সেবা দেওয়ার মাধ্যমে একজন সাধারণ মানুষও আরেকজন মানুষের জীবন রক্ষার্থে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন।
শাহনূর শারমিন: সহযোগী অধ্যাপক, মেডিসিন বিভাগ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ