স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর সংবিধান প্রণীত হয়। এটি ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম বাংলা ভাষায় প্রণীত সংবিধান। যে সংবিধানে তিনি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করেন। ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ দিয়ে যে ঐতিহাসিক ভূমিকা তিনি পালন করেছেন, তা ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। বিশ্বসভায় বাংলাকে এর আগে কেউ এভাবে তুলে ধরেননি।
১৯৭৫ সালের ১২ মার্চ রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অফিসের কাজে বাংলা ভাষা প্রচলনে সরকারি প্রজ্ঞাপন জারি করেন ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্যে অমিল থাকার পরও কেবল ধর্মের দোহাই দিয়ে ১ হাজার ২০০ মাইল ব্যবধানের দুইটি পৃথক ভূখণ্ডকে এক করে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের জন্ম হয়। সমগ্র পাকিস্তানে ৫৬ শতাংশ মানুষের ভাষা ছিল বাংলা; অন্যদিকে ৭.২ শতাংশ মানুষ কথা বলত উর্দুতে। সেই উর্দুকেই পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী রাষ্ট্রভাষা করার জন্য পাঁয়তারা শুরু করে। কলকাতায় একটি অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক আন্দোলন ও সংগঠন করার সিদ্ধান্ত হয়। এতে নেতৃত্ব দেন তত্কালীন ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান।
শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্যোগ ও স্বাক্ষরে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের নামে ১৯৪৮ সালের ১৩ জানুয়ারি পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার জন্য একটি লিফলেট প্রচার করা হয়। এই লিফলেট সম্পর্কে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্ট বলা হয়েছে, ‘I have the honor to report the particulars of the members of the Provisional Organizing Committee of East Pakistan Muslim Students League as follow. They were the signatories the leaflet which advocated Bengali to be the State Language for Pakistan.’ গোয়েন্দা সংস্থা’র প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করা হয়, ‘Sheikh Mujibur Rahman, who was one of the signatories of the leaflet which advocated Bengali to be the Students League of Pakistan.’
১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব করলে তাকে সমালোচনা করেন লিয়াকত আলী খান। পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধি খাজা নাজিমুদ্দিন এবং তমিজউদ্দিন খান বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার রিরোধিতা করেন। ২৬ ফেব্রুয়ারি তমদ্দুন মজলিসের আহ্বানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হয়। এ ধর্মঘটে শেখ মুজিবুর রহমান সাহসী ভূমিকা রাখেন। ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। এই হরতালে তরুণ শেখ মুজিব নেতৃত্ব দেন এবং পুলিশি নির্যাতনের শিকার হয়ে গ্রেফতার হন। ‘কারাগারের রোজনামচা’ গ্রন্থে এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘প্রথম ভাষা আন্দোলন শুরু হয় ১১ ই মার্চ ১৯৪৮ সালে। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ (এখন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ) ও তমদ্দুন মজলিসের নেতৃত্বে। ঐদিন ১০টায় আমি, জনাব শামসুল হক সাহেবসহ প্রায় ৭৫ জন ছাত্র গ্রেফতার হই এবং আবদুল ওয়াদুদসহ অনেকেই ভীষণভাবে আহত হয়ে গ্রেফতার হয়’।
১৬ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ভাষা আন্দোলনকে বেগবান করার লক্ষ্যে এক সাধারণ ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয়। ঐ সভায় সভাপতিত্ব করেন সদ্য কারামুক্ত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলা ভাষার আন্দোলন সমগ্র পূর্ববাংলায় একটি গণ-আন্দোলন হিসেবে ছড়িয়ে পড়ে। রাস্তায়, দেওয়ালে-দেওয়ালে পোস্টার রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই। ২১ মার্চ মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ রেসকোর্স ময়দানের সমাবেশে ঘোষণা করেন, ‘Let me make it very clear to you that the state language of Pakistan is going to be Urdu and no other language. Anyone who tries to mislead you is really the enemy of Pakistan…Therefore, so far as the state language is concerned, Pakistan’s shall be Urdu.’ শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার নেতৃত্বে উপস্থিত ছাত্র-জনতা তীব্র প্রতিবাদ করেন।
ভাষা আন্দোলনের বিস্ফোরণ পর্বে ১৬ ফেব্রুয়ারি জেলে থাকা অবস্থাতেই শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি এবং পূর্ব পাকিস্তানে সব ধরনের নিপীড়ন অবসানের দাবিতে অনশন শুরু করেন। ঢাকা কারাগারে তার সঙ্গে ঢাকার ছাত্রদের যেন কোনো যোগাযোগ না হয়, সেজন্য তাকে ফরিদপুর জেলে স্থানান্তরিত করা হয়। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘আমি হাসপাতালে আছি। সন্ধ্যায় মোহাম্মদ তোয়াহা ও অলি আহাদ দেখা করতে আসে।…আমি ওদের রাত একটার পর আসতে বললাম।…দরজার বাইরে আইবিরা পাহারা দিত।…বারান্দায় বসে আলাপ হল এবং আমি বললাম, সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করতে।…সেখানে ঠিক হল, আগামী একুশে ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা দিবস পালন করা হবে এবং সভা করে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করতে হবে’।
২০ ফেব্রুয়ারি আন্দোলন দমনে পাকিস্তান সরকার ১৪৪ ধারা জারি করে। রাতভর বিভিন্ন হল ও ছাত্রাবাসে চলে ১৪৪ ধারা ভাঙার প্রস্তুতিমূলক সভা। ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্ররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় সমবেত হয়ে মিছিলে অংশগ্রহণ করে। ২১ ফেব্রুয়ারি ও ২২ ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে শহিদ হন সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিউর, আব্দুস সালাম, অলিউল্লাহ (মতান্তরে ওহিউল্লাহ) প্রমুখ এবং বহু নেতা পুলিশি নির্যাতনের শিকার হন। প্রতিবাদে সারা বাংলায় বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। ২৭ এপ্রিল সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের জেলা ও মহকুমা প্রতিনিধি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি হিসেবে বক্তব্য রাখেন দলের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান।
১৯৫৩ সালে একুশের প্রথম বার্ষিকী পালনেও বঙ্গবন্ধুর যথেষ্ট ভূমিকা ছিল। সেদিন সব আন্দোলন, মিছিল এবং নেতৃত্বের পুরোভাগে ছিলেন আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আরমানিটোলা ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায় তিনি সেদিন একুশে ফেব্রুয়ারিকে ‘শহিদ দিবস’ হিসেবে ঘোষণা দেওয়ার আহ্বান জানান এবং অবিলম্বে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানান। তিনি বলেন, ‘আজ পাকিস্তান সরকারের সম্মুখে শুধুমাত্র দুইটি পথ খোলা রহিয়াছে—হয় তাঁহারা বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষারূপে মানিয়া লইবেন, নতুবা গদি ছাড়িবেন’।
ভাষা আন্দোলনের চেতনাকে কাজে লাগিয়ে ১৯৫৩ সালের ৪ ডিসেম্বর যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়। যুক্তফ্রন্ট প্রণীত ২১-দফার প্রথম দফা ছিল ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। ১৯৫৫ সালের ২৫ আগস্ট করাচিতে পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশনে তিনি বলেন, …‘ওরা পূর্ব বাংলা নামের পরিবর্তে পূর্ব পাকিস্তান নাম রাখতে চায়। আমরা বহুবার দাবি জানিয়েছি যে, আপনারা এটাকে বাংলা নামে ডাকেন। ‘বাংলা’ শব্দটির একটা নিজস্ব ইতিহাস আছে, আছে এর একটা ঐতিহ্য…’।
১৯৫৬ সালের ১৭ জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত আইন পরিষদের অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু সংসদের দৈনন্দিন কার্যসূচি বাংলা ভাষায় মুদ্রণ করার দাবি জানান। ৭ ফেব্রুয়ারির অধিবেশনে তিনি খসড়া শাসনতন্ত্রের অন্তর্গত জাতীয় ভাষা সংক্রান্ত প্রশ্নে তিনি বলেছিলেন, ‘পূর্ববঙ্গে আমরা সরকারি ভাষা বলতে রাষ্ট্রীয় ভাষা বুঝি না। কাজেই খসড়া শাসনতন্ত্রে রাষ্ট্রের ভাষা সম্পর্কে যেসব শব্দ ব্যবহূত হয়েছে, তা কুমতলবে করা হয়েছে।’ পাকিস্তানের জনগণের শতকরা ৫৬ ভাগ লোকই বাংলা ভাষায় কথা বলে, এ কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, ‘রাষ্ট্রীয় ভাষার প্রশ্নে কোনো ধোঁকাবাজি করা যাবে না। পূর্ববঙ্গের জনগণের দাবি এই যে, বাংলাও রাষ্ট্রভাষা হোক।’ ১৬ ফেব্রুয়ারি তারিখে আইনসভার অধিবেশনেও তিনি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানান। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ২৩ মার্চ পাকিস্তান সরকার কর্তৃক গৃহীত প্রথম সংবিধানে বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়।
১৯৭১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘স্বাধিকার আন্দোলনের ক্ষেত্রে জাতীয় জীবনে ফেব্রুয়ারির গুরুত্ব অপরিসীম। বাংলা একাডেমি যে সপ্তাহ পালন করছে সে সপ্তাহ বাংলাদেশের জীবনে এক কঠিন সপ্তাহ। ফেব্রুয়ারির এই দিনেই বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছেন ভাষা আন্দোলনের শহীদেরা, এই সপ্তাহেই কুর্মিটোলার বন্দিশিবিরে হত্যা করা হয়েছে সার্জেন্ট জহুরুল হককে, এই সপ্তাহেই শহীদ হয়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. শামসুজ্জোহা, আর এই সপ্তাহেই কারফিউ নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করে আত্মাহুতি দিয়েছে এ দেশের অসংখ্য মায়ের অসংখ্য নাম না জানা সন্তান।…ভাষা আন্দোলনের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে আমি ঘোষণা করছি, আমার দল ক্ষমতা গ্রহণের দিন থেকেই সকল সরকারি অফিস-আদালত ও জাতীয় জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে বাংলা চালু করবে।’
স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর সংবিধান প্রণীত হয়। এটি ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম বাংলা ভাষায় প্রণীত সংবিধান। যে সংবিধানে তিনি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করেন। ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ দিয়ে যে ঐতিহাসিক ভূমিকা তিনি পালন করেছেন, তা ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। বিশ্বসভায় বাংলাকে এর আগে কেউ এভাবে তুলে ধরেননি। ১৯৭৫ সালের ১২ মার্চ রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অফিসের কাজে বাংলা ভাষা প্রচলনে সরকারি প্রজ্ঞাপন জারি করেন।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভাষা আন্দোলন করেছিলেন, বাংলা ভাষার চেতনাকে বুকে ধারণ করেছিলেন। বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় তার মতো এমন মহানায়ক আর কে আছেন বাংলায়! ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জাতির উদ্দেশে ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘…ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার সময় আমি বলব, আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা। জয় বাংলা।’