আর একদিন পরেই পালিত হতে যাচ্ছে বিশ্ব ভালোবাসা দিবস, বসন্তের প্রথম দিন পহেলা ফাল্গুন ও সনাতন ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম বড় ধর্মীয় উৎসব সরস্বতী পূজা। এই তিন উৎসব ঘিরে রাজধানীতে বেড়েছে ফুলের কদর।
মঙ্গলবার (১৩ ফেব্রুয়ারি) রাজধানীর শাহবাগের বটতলা ফুলের মার্কেট ঘুরে দেখা যায়, বিশ্ব ভালোবাসা দিবস, পহেলা ফাল্গুন ও সরস্বতী পূজা উপলক্ষে এরই মধ্যে জমে উঠেছে এখানকার ফুল দোকানগুলো। প্রতিটি দোকানই নানান রকম দেশি-বিদেশি ফুল দিয়ে ভর্তি। বিভিন্ন রং ও ধরনের গোলাপ, চন্দ্রমল্লিকা, গ্ল্যাডিওলাস, জারবেরা, রজনীগন্ধা, লিলি, গাঁদা, জিপসি, মাম, ক্যালেন্ডোলা ফুল সাজিয়ে রেখেছেন বিক্রেতারা। ফুল দিয়ে তৈরি মালা, মাথার রিং, গাজরাও পাওয়া যাচ্ছে সেসব দোকানে।
উৎসব তিনটি একদিন পরে হলেও আজ থেকেই ক্রেতাদের ভিড় নেমেছে শাহবাগের ফুল দোকানগুলোয়। সকাল থেকে তরুণ-তরুণীসহ বিভিন্ন বয়সী মানুষ সাজগোজ করে ভিড় জমাচ্ছেন ফুল কিনতে। কেউবা প্রিয়জনের জন্য ফুল কিনছেন, কেউবা কিনছেন নিজের জন্য, কেউবা পরিবার আবার কেউ কিনছেন পূজার জন্য। সাধারণ ক্রেতার পাশাপাশি বিভিন্ন জায়গা থেকে ব্যবসায়ীরাও আসছেন এই ফুল মার্কেটে ফুল কিনতে। সব মিলেয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন বিক্রেতারা। প্রায় কারোরই বসে থাকার ফুসরত নেই।
বিশেষ দিবস ঘিরে ফুলের দাম বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি:
একই দিনে তিন উৎসব হওয়ায় ফুলের চাহিদা যেমন বেড়েছে তেমনি বেড়েছে দামও। বিশ্ব ভালোবাসা দিবসে সব সময় ক্রেতাদের চাহিদার শীর্ষে থাকে গোলাপ। শাহবাগের বটতলা ফুল দোকানগুলোয় বর্তমানে দাম ভেদে প্রতিটি দেশি গোলাপ বিক্রি হচ্ছে ৪০ থেকে ৬০ টাকা, যা সাধারণ সময়ে ১০ থেকে ২০ টাকায় বিক্রি হয়। ৪০ টাকার প্রতিটি চায়না গোলাপ বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৮০ টাকা। অন্য জাতের বিদেশি গোলাপ প্রতিটি বিক্রি হচ্ছে ১০০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত, যা সাধারণ সময়ে ৫০ থেকে ৮০ টাকায় বিক্রি করেন বিক্রেতারা।
এছাড়া বর্তমানে প্রতিটি চন্দ্রমল্লিকা ৩০ টাকা, গ্ল্যাডিওলাস ৪০ টাকা, জারবেরা ৩০ টাকা, রজনীগন্ধার স্টিক ২০ থেকে ৩০ টাকা, লিলি (আঁটি) ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা, ক্যালেন্ডোলা ১০ থেকে ২০ টাকা, চায়না মাম (আঁটি) ১০০ টাকা, সবুজ মাম (আঁটি) ৮০ টাকা, জিপসি (আঁটি) ৪০ থেকে ২০০ টাকা, গাঁদার লতা ১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
সাধারণ সময়ে প্রতিটি চন্দ্রমল্লিকা ৫ থেকে ১০ টাকা, গ্ল্যাডিওলাস ২০ টাকা, জারবেরা ১৫ থেকে ২০ টাকা, রজনীগন্ধার স্টিক ১০ থেকে ১৫ টাকা, লিলি (আঁটি) ৩০০ টাকা, ক্যালেন্ডোলা ৫ থেকে ১০ টাকা, চায়না মাম (আঁটি) ৫০ টাকা, সবুজ মাম (আঁটি) ৫০ টাকা, জিপসি (আঁটি) ১০ থেকে ৫০ টাকা, গাঁদার লতা ৪০ থেকে ৫০ টাকায় বিক্রি হয়।
ফুল ছাড়াও বর্তমানে বেলির মালা প্রতিটি ২০ টাকা, মাথার রিং ১৫০ থেকে ২০০ টাকা, চন্দ্রমল্লিকার গাজরা ৫০ থেকে ৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। যেগুলো সাধারণ সময়ে যথাক্রমে ২০ টাকা, ৮০ থেকে ১০০ টাকা, ২০ থেকে ৩০ টাকায় বিক্রি হয়। অর্থাৎ বিশেষ দিবস ঘিরে ফুলের দাম দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে।
এছাড়া বিভিন্ন ধরনের ফুলের তোড়া ফুল ও আকার অনুযায়ী ৫০০ থেকে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। সাধারণ সময়ে এই ফুলের তোড়ার দামও কম থাকে।
যা বলছেন বিক্রেতারা:
শাহবাগের বটতলার আলাউদ্দিন ফুল ঘরের বিক্রেতা বাদল ইসলাম খোকা বলেন, বিভিন্ন দিবসে ফুলের চাহিদা কয়েকগুণ বেড়ে যায়, যার কারণে দামও একটু বেশি থাকে। তবে এই দাম আমরা ইচ্ছা করে বাড়াই না। চাষি থেকে শুরু করে পাইকারি বিক্রেতা সবাই বেশি দাম রাখে। এর করণে আমাদেরও বাধ্য হয়ে বাড়তি দামে বিক্রি করতে হয়। আর এই একদিন ব্যবসার জন্যই আমরা বসে থাকি। এই তিন দিবস ঘিরে ৩ লাখ টাকার ফুল কিনেছি। আশা করি সব মিলিয়ে ৫ লাখ টাকার মতো ব্যবসা হবে। এবার পরিস্থিতি ভালো, সকাল থেকেই ভালো ক্রেতা রয়েছে। আশা করি, বিকেলে ও কাল আরও বেশি বিক্রি হবে।
তবে ভিন্ন কথা বলছেন মাহমুদা পুষ্পালয়ের সত্ত্বাধিকারী ইসলাম হোসেন মন্টু। তিনি বলেন, গত বছরের তুলনায় এবার ক্রেতা কম। ফুলের দামও গত বছরের এই দিবসে যা ছিল, তার থেকে কম। পরশু থেকে এসএসসি পরীক্ষা শুরু হওয়ায় এবার অনেকে ভালোবাসা দিবস ও পহেলা ফাল্গুনে বের হবে না। যার কারণে বেচাকেনা কম। তবে বাজারে এবার ফুলের সংকট নেই। যথেষ্ট পরিমাণ ফুল আছে। যার কারণে বিশেষ দিন হিসেবে দাম এবার তুলনামূলক কম। এক লাখ ২০ হাজার টাকার ফুল কিনেছে, আশা করি ২ লাখ টাকার মতো ব্যবসা হবে।
একই কথা বলেন মো. হোসেন নামের আরেক বিক্রেতা। তিনি বলেন, গত বছর ভালোবাসা দিবসের আগে দোকান ক্রেতাদের জায়গা দেওয়ার মতো অবস্থা ছিল না। কিন্তু এবার ক্রেতা নেই বললেই চলে। দুই-তিনজন করে আসছে। আশা করি বিকেলে লোকজন হবে। তবে একই দিনে তিনটি বিশেষ উৎসব হওয়ায় আমাদের জন্য খারাপ হয়েছে। একেক উৎসব একেক দিন হলে আমরাও তিনদিন আলাদা আলাদাভাবে ফুল বিক্রি করতে পারতাম। এবার ৪ লাখ টাকার ফুল কিনেছি। দেখি বিক্রি করতে পারি কি না।
ফুলের দাম বেশি হলেও ভ্রুক্ষেপ নেই ক্রেতাদের:
ফুলের দাম বেশি হলেও এ নিয়ে ক্রেতাদের মধ্যে তেমন প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। বরং প্রায় প্রতিটি দোকানে ক্রেতাদের ভিড় দেখা যায়। বান্ধবীদের নিয়ে শাহবাগে ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন রকমের ফুল কিনতে দেখা যায় লুবনা নামের এক শিক্ষার্থীকে। তিনি বলেন, প্রতি বছরই পহেলা ফাল্গুনে সাজগোজ করে বের হই। সেই সাজগোজ অনেকখানি বাড়িয়ে দেয় ফুল। আজকে যেহেতু এদিকে ঘুরতে এসেছি, তাই নিজের জন্য ফুল কিনে নিয়ে যাচ্ছি। ফুলের দাম একটু বেশি, তবে দামাদামি করলে কমেই কেনা যাচ্ছে। আর বিশেষ দিনে বিক্রেতারা দাম একটু বেশি রাখবে এটাই স্বাভাবিক।
প্রিয়তমাকে নিয়ে ফুল কিনতে এসেছেন একটি ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির ম্যানেজার ইসরাফুল ইসলাম। তিনি বলেন, বিভিন্ন দিবসে ফুলের দাম বেশি থাকে। তবে চাষিরা এর দাম পায় না। যে ফুল দোকানে ১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, সেই ফুল চাষি হয়তো বিক্রি করেছে মাত্র ১০ টাকায়। এই বিষয়টি দোকান মালিক সমিতির দেখা উচিত।
৫০ লাখ টাকার ফুল বিক্রির প্রত্যাশা ব্যবসায়ীদের:
শাহবাগ বটতলা ক্ষুদ্র ফুল ব্যবসায়ী সমবায় সমিতি লিমিটেডের সভাপতি মো. আবুল কালাম আজাদ বলেন, অন্যবারের তুলনায় এবার ক্রেতা তুলনামূলক কম। আশা করি বিকেল বা সন্ধ্যায় ক্রেতার সংখ্যা বাড়বে। এবার বিশ্ব ভালোবাসা দিবস, পহেলা ফাল্গুন ও সরস্বতী পূজা উপলক্ষে সারা দেশে ১০-১২ কোটি টাকার ফুল বিক্রি হবে আশা করি। শাহবাগে ৫০টি দোকান রয়েছে। এসব দোকানে ৫০ লাখ টাকার মতো ব্যবসা হবে প্রত্যাশা করছি।
ফুলের দাম বাড়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রকৃতপক্ষে ফুলের দাম দোকানদার বা চাষি কেউই বাড়ায় না। এসব দিবসকে কেন্দ্র করে মধ্যসত্ত্বভোগীরা দাম বাড়ায়। চাষিরা যেখানে ফুল বিক্রি করে সেখানে থেকে শুরু করে পাইকারি দোকানদারদের কাছে আসার মাঝপথে ফুলের দাম বেড়ে যায়। আবার ১০০ টাকা ফুল কিনলে সেখানে ২০টা ফুল কম থাকে বা নষ্ট হয়ে যায়। যার করণে সেই ক্ষতির টাকাটা ফুলের মধ্যে পড়ে দাম বেড়ে যায়। তবে লাভবান হয় শুধু ওই মধ্যসত্ত্বভোগীরা।
ক্রেতারাও চালাক উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, প্রত্যেক ক্রেতাই তার নিজ নিজ জায়গায় অনেক চালাক। বিশেষ দিবসে ফুলের দাম বেড়ে যায় তারা সেটি জানে। তাই দুই-তিন দিন আগে থেকে ফুল কিনে সেটি পানিতে ভিজিয়ে রাখে।
ফুলের দাম বাড়ার বিষয়ে যা বলছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ও ক্যাব:
ফুল নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মধ্যে পড়ে না জানিয়ে কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বাংলানিউজকে বলেন, কোনো কিছুর চাহিদা যখন বেড়ে যায়, দামও তখন বাড়ে এটাই স্বাভাবিক। এটা ক্রেতার সঙ্গে প্রতারণা নয়। ফুল তো এমন কোনো জিনিস নয় যে কিনতেই হবে। যার সামর্থ্য আছে, তিনি কিনবেন। যার সামর্থ্য নেই, তিনি কিনবেন না। এটা নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য নয়, যে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। এখানে দেখার বিষয় কৃত্রিম সংকট হচ্ছে কি না।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) এ. এইচ. এম সফিকুজ্জামান বলেন, ফুল নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য নয়। এটা মননের বিষয়। কারও যদি না পোষায় তার ফুল কেনার দরকার নেই। এটা তো চাল-ডাল নয়, যে না খেয়ে থাকতে হবে। এটি নিয়ন্ত্রিত কোনো পণ্য নয়। শাহবাগে ফুলের যে দাম রাখা হয়, গুলশানে হয়তো এর থেকে পাঁচগুণ দাম রাখা হয়।
তবে কোনো ক্রেতা এই বিষয়ে অভিযোগ জানালে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ব্যবস্থা নেবে বলে জানান তিনি।