প্রায় এক মাস আগে গাজীপুরের রাজেন্দ্রপুর থেকে অপহরণ করা হয় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী হাসিবুর রহমান হিমেলকে। সামিদুল নামে এক গাড়ি চালকের কথায় পটে তিনি ব্যাটারি বিক্রি করতে সেখানে গিয়েছিলেন।হিমেল অপহরণের ঘটনায় মূলহোতা মালেকসহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করেছে এলিট ফোর্স র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)।
বুধবার (২৪ জানুয়ারি) রাতে সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে হিমলেকে উদ্ধার করা হয়। বিষয়টি গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেছেন র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী হিমেলকে অপহরণের পর পাশবিক কায়দায় নির্যাতন ও মুক্তিপণ চাওয়া হয়। অপহরণ চক্রের মূলহোতা মালেকসহ ৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এসময় আগ্নেয়াস্ত্র, গোলাবারুদ ও ওয়াকিটকিসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়।
র্যাবের বয়ানে হিমেল উদ্ধারের বর্ণনা
বৃহস্পতিবার (২৫ জানুয়ারি) রাজধানীর কারওয়ানবাজারে মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে হিমেলকে অপহরণ ও উদ্ধারের বর্ণনা দেন কমান্ডার খন্দকার আল মঈন। তিনি জানান, ভুক্তভোগী হাসিবুর রহমান হিমেল ছিলেন ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস এগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনোলজির (আইইউবিএটি) মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী। তাকের অপহরণের মূল উদ্দেশ ছিল পাশবিক নির্যাতন ও হুমকি দিয়ে মোটা অঙ্কের মুক্তিপণ আদায় করে তাকে ছেড়ে দেওয়া। অপহরণে জড়িত গাড়ি চালক সামিদুলকেও অপহৃত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল। অপরাধীদের উদ্দেশ্য ছিল, পরবর্তীতে আবারও হিমেলকে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়।
চার বছর ধরে হিমেলের বাসায় গাড়ি চালক হিসেবে কর্মরত ছিলেন সামিদুল। সুসম্পর্ক বজায় রেখে তিনি কৌশলে হিমেলের পরিবারের আর্থিক ও সম্পত্তি সংক্রান্ত তথ্য জেনে নেন। ২০২৩ সালের ১৬ ডিসেম্বর পেশাদার অপহরণকারী মালেকের নেতৃত্বে উত্তরায় হিমেলকে অপহরণের পরিকল্পনায় যোগ দেন সামিদুল।
পরিকল্পনা অনুযায়ী তিনি শেরপুরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ব্যাটারি বিক্রির সম্ভাবনার কথা জানিয়ে হিমেলকে সেখানে যেতে আগ্রহী করে। গত ২৬ ডিসেম্বর সকালে শেরপুরের উদ্দেশ্যে রওনা করেন তারা। গাজীপুরের সালনায় এলাকায় গেলে সামিদুল ও হিমেলকে গাড়িসহ আটকে জিম্মি করে ফেলে অপরাধীরা। পরে তাদের ময়মনসিংহের সীমান্তবর্তী এলাকা ধোবাউড়ায় নেওয়া হয়।
এরপর গ্রেপ্তার মালেকের দুই সহযোগী রাসেল ও বিল্লাল তাদের ধোবাউড়ায় পৌঁছে দিয়ে গাড়িটি গাজীপুরের বাসন এলাকায় নিয়ে এসে রাখেন। এরপর বিল্লাল ময়মনসিংহ ফিরে যান। রাসেল উত্তরায় অবস্থান করে হিমেলের মায়ের গতিবিধি অনুসরণ করতে থাকেন। র্যাব রাসেল ও বিল্লালকে গ্রেপ্তার করেছে।
ধোবাউড়ায় তিনদিন অবস্থানের পর বিল্লাল ছাড়া মালেক, ছামিদুল ও অপহরণ চক্রের অন্য সদস্যরা হিমেলকে নিয়ে সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের সীমান্তবর্তী এলাকায় নিয়ে যায়। এরপর রনি নামে মালেকের এক সহযোগীর মাধ্যমে তাহিরপুরের সীমান্তবর্তী পাহাড়ি এলাকায় পাহাড় পরিবর্তন করে অবস্থান করতে থাকে। তারা ভুক্তভোগী হিমেলকে পাশবিক নির্যাতন করে ভিডিও ধারণ করে। সেগুলো হিমেলের মায়ের কাছে পাঠিয়ে কোটি টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। রনিকেও গ্রেপ্তার করেছে র্যাব।
খন্দকার মঈন বলেন, ২৬ ডিসেম্বর সকালে শেরপুর যাওয়ার সময় অপহরণের শিকার হিমেলের মোবাইল ফোন নম্বরে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করে তার পরিবার। কিন্তু নম্বরটি বন্ধ ছিল। অনেক চেষ্টার পরও ছেলেকে না পেয়ে হিমেলের মা তহুরা বিনতে হক উত্তরা পশ্চিম থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। গত ২৮ ডিসেম্বর গাজীপুরের বাসন এলাকায় পরিত্যক্ত অবস্থায় আইন রক্ষাকারী বাহিনী হিমেলের গাড়িটি উদ্ধার করে।
পরবর্তীতে অজ্ঞাত এক ব্যক্তি হিমেলের মায়ের হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে ফোন করে অপহরণের বিষয়টি জানায়। একই সময় হিমেলের মুক্তিতে ২ কোটি টাকা পণ দাবি করে। মুক্তিপণ আদায়ের জন্য পরিবারকে ভয় দেখাতে তিনি হিমেলকে পাশবিক কায়দায় নির্যাতনের ভিডিও পাঠায়। এরপর তহুরার ভাই (হিমেলের মামা) বাদি হয়ে রাজধানীর উত্তরা পশ্চিম থানায় একটি অপহরণের মামলা দায়ের করেন। গত ছয় জানুয়ারি মামলার পর তহুরা ছেলেকে উদ্ধারে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের কাছে অভিযোগ নিয়ে আসেন।
এরপর যা হলো
এরই ধারাবাহিকতায় গত ২৩ জানুয়ারি র্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা ও র্যাবের তিনটি শাখা (১, ৯ ও ১৪) সুনামগঞ্জের তাহিরপুর এলাকায় অভিযান চালিয়ে অপহরণকারী চক্রের মূলহোতা ও পরিকল্পনাকারী মো. আব্দুল মালেক তার অন্যতম সহযোগী ও পরিকল্পনাকারী ড্রাইভার সামিদুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করে। তারপর তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে বুধবার রাতে অপহৃত হাসিবুর রহমান ওরফে হিমেলকে তাহিরপুরের সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে উদ্ধার করা হয়।
হিমেল উদ্ধার কর্মকাণ্ডের সময় গ্রেপ্তার হন রনি। পরে তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে উত্তরা থেকে রাসেল ও বিল্লাল নামে চক্রের দুই সদস্যকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। তাদের কাছ থেকে একটি বিদেশি পিস্তল, দুই রাউন্ড গুলি ও দুটি ওয়াকিটকি সেট জব্দ করা হয়।
কমান্ডার মঈন জানান, হিমেলের বাবা ব্যাটারির ব্যবসা করতেন। তার মৃত্যুর পর এ ব্যবসায় নামেন হিমেল। তাকের অপহরণের পর একটি বিদেশি হোয়াটসঅ্যাপ নাম্বার থেকে ঘটনাটি তার মাকে জানানো হয়। হিমেলকে পাশবিক কায়দায় নির্যাতনের ভিডিও পাঠিয়ে তার কাছ থেকে প্রথমে ২ কোটি টাকা দাবি করেন মালেক গং। পরে এক কোটি; ৫০ লাখ; ৩০ লাখ টাকাও মুক্তিপণ দাবি করেন তারা।
টাকা না দিলে হিমেলকে মেরে ফেলা হবে বলেও হুমকি দেওয়া হয়। হিমেলের মা তহুরাকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করেন মালেক ও তার দলের লোকজন। পরিবারের লোকজনকেও মেরে ফেলার কথা বলা হয়। এরপর তহুরা ছেলেকে ফিরে পেতে মুক্তিপণ দেবেন বলে রাজি হন।
অপহরণকারীরা গত ২৩ জানুয়ারি হিমেলের পরিবারকে তাহিরপুর যেতে বলে। বিষয়টি তহুরা বিনতে হক র্যাবকে জানান। তিনি এদিন আগে নেত্রকোনায় যান। পরে মালেক ও সামিদুল তাকে তাহিরপুর যেতে বলেন। সেখান থেকে র্যাব এ দুজনকে গ্রেপ্তার করে। এ সময় র্যাবের এক কর্মকর্তাসহ দুজন আহত হন।
গ্রেপ্তারের পর মালেক ও সামিদুল তথ্য দিলে তাহিরপুরে পাহাড়ি টিলা এলাকা থেকে হিমেলকে উদ্ধার করা হয়। তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাত রয়েছে, তিনি মানসিক বিপর্যস্ত অবস্থায় ছিলেন। উদ্ধারের সময় রনিকে ধরতে পারলেও চক্রের দুই সদস্য পালিয়ে যায়।
গ্রেপ্তারদের বিষয়ে কমান্ডার মঈন বলেন, মালেক পেশায় একজন গাড়ি চালক। এর পাশাপাশি তিনি একটি সংঘবদ্ধ অপহরণ চক্রের নেতৃত্ব দিতেন। ধনাঢ্য পরিবারের সদস্যদের টার্গেট করে মোটা অংকের মুক্তিপণ আদায় করতেন মালেক। পণ দিতে অস্বীকৃতি জানালে তারা পৈশাচিক নির্যাতনের ভিডিও ধারণ করে আত্মীয়-স্বজনের কাছে পাঠিয়ে অর্থ আদায় করতেন।
মালেকের বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন থানায় অপহরণ, অস্ত্র আইন, বিস্ফোরক আইন, ডাকাতি-ছিনতাই ও খুনসহ ১৪টির অধিক মামলা রয়েছে। এসব মামলায় তিনি আট বছরের বেশি সময় কারাভোগ করেছেন। সর্বশেষ ময়মনসিংহের এক অধ্যাপকের ছেলেকে অপহরণের ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলায় তিনবছর কারাভোগ করে মালেক। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে তিনি ছাড়া পেয়েছিলেন।
গ্রেপ্তার সামিদুল পেশায় একজন গাড়ি চালক। পাশাপাশি তিনি মালেকের অন্যতম সহযোগী। দীর্ঘদিন ধরে তিনি হিমেলের পরিবারের গাড়ি চালানোর কারণে বিশ্বাসী হয়ে ওঠেন। ব্যাংকিং বিভিন্ন আর্থিক লেনদেন ও সঞ্চিত অর্থ সম্পর্কেও তার ভাল ধারণা ছিল। হিমেলের বাবার মৃত্যুর পর মালেকের নেতৃত্বে তাকে অপহরণপূর্বক মোটা অংকের মুক্তিপণ আদায়ের পরিকল্পনা করেছিলেন সামিদুল।
বৃহস্পতিবার দুপুরে র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে তিনিও কথা বলেন। সন্তানকে ফিরে পেয়ে অপহরণকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন তিনি।
তহুরা বলেন, আমি বোঝাতে পারবো না একজন মায়ের পক্ষে এটা সহ্য করা সম্ভব কিনা! যারা আমার ছেলেকে অপহরণ, নির্যাতন করেছে মালেক, সামিদুলকে যেন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হয়। তারা আমার ছেলের লাইফটা (জীবন) শেষ করে দিয়েছে। প্রশাসনের কাছে যেন না যাই, সেজন্য তারা হুমকি দিতো। বলতো ছেলেকে মেরে ফেলবে। বার বার ওকে জবাই করার হুমকি দিচ্ছিল। ছেলেকে উদ্ধার করে দেওয়ায় তিনি র্যাবকে ধন্যবাদও জানান।