শয্যাশায়ী হয়েও পরীক্ষায় বসেছিলেন সামিয়া, শেষ পর্যন্ত সম্ভব হলো না

শয্যাশায়ী হয়েও পরীক্ষায় বসেছিলেন সামিয়া, শেষ পর্যন্ত সম্ভব হলো না

‘আমার এত দিনের কষ্ট শেষ করে দিল ডেঙ্গু। বিশ্বাস হচ্ছে না হেরে গেলাম। এই মশারির মধ্যে আমার কবরের মতো লাগে। এখন মশারি ছাড়া আমি অন্যদের জন্য ঝুঁকির,’ ডেঙ্গু আক্রান্ত সামিয়া খানম আজ বুধবার দুপুরে বিছানায় শুয়ে শুয়ে এমন কাতর স্বরে বিলাপ করছিলেন। বিষাদ ঝরে পড়ছিল তাঁর কণ্ঠে। রাজধানীর আগারগাঁওয়ের বাসিন্দা সামিয়া এ বছরের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থী।

সামিয়ার বাবা আমজাদ খান একটি দরজির দোকানে প্যান্ট তৈরির কাজ করেন। একমাত্র ভাই আগারগাঁওয়ে কাজ করেন একটি শোরুমের কর্মী হিসেবে। অল্প আয়ের পরিবারটি দেড় বছর আগে মানিকগঞ্জ থেকে রাজধানীতে আসে শুধু মেয়েদের পড়ালেখার জন্য। সামিয়ার ছোট বোন পড়ে শান্তিনগরের একটি স্কুলে। পরিবারটি এত দিন শান্তিনগরেই বসবাস করত। সম্প্রতি তারা কিছুটা কমে বাসা ভাড়া পাওয়ায় আগারগাঁওয়ের একটি বাসায় ওঠে। এখানে তারা সাত সদস্যের পরিবার থাকে। সেখান থেকে তেঁজগাও আর শান্তিনগরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দুই বোনের বাসে যাতায়াতে রোজ খরচ হয় সর্বনিম্ন ৪০ টাকা করে।

সামিয়ার স্বজনেরা জানান, আগারগাঁও থেকে তেজগাঁও বা শান্তিনগর, যেখানেই বাসে করে যাক, তার জন্য প্রতিবার ১০ টাকা করে লাগে। তবে পরিবারের অন্যদের কর্মস্থল আগারগাঁও হওয়ায় তারা সেখানে উঠেছে। খরচে কুলিয়ে উঠতে পারছিল না বলে পরিবারটি আবার মানিকগঞ্জে ফিরে যাওয়ার কথা ভাবছিল। সামিয়া নিজের পড়ালেখার পাশাপাশি রাজধানীর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে ছয় মাসের ‘কেয়ার গিভিং’ কোর্স করেছেন। এ বছরের জুনে কোর্স শেষ হওয়ার পর তিনি সর্বোচ্চ চেষ্টা করছিলেন এইচএসসি পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য। পরীক্ষাটা হয়ে গেলে কোথাও কাজের জন্য আবেদন করতেন সামিয়া। পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি পরিবারের জন্য একটু সুবিধা হতো। কিন্তু তা আর এখন সম্ভব হলো না ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ায়।

সামিয়ার এইচএসসি পরীক্ষার কেন্দ্র ছিল ঢাকা বিজ্ঞান কলেজ। ১৭ আগস্ট প্রথম পরীক্ষাটি ছিল বাংলা প্রথম পত্র। কেন্দ্রে গিয়ে পরীক্ষা দিয়েছেন জ্বর নিয়ে। ১৮ আগস্ট অবস্থার অবনতি হলে তাঁকে ভর্তি করা হয় শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। ক্রমে অবনতি হতে থাকে শরীরের। বিশেষ ব্যবস্থায় পরীক্ষা দেওয়ার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০ আগস্ট তিনি বিজ্ঞান কলেজে পৃথক কক্ষে মশারির মধ্যে আধশোয়া হয়ে বাংলা দ্বিতীয় পত্র পরীক্ষা দিয়ে আবার হাসাপাতালে ফিরে যান। ২২ তারিখ ইংরেজি প্রথম পত্র পরীক্ষার আগে তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। কোনোভাবেই আর পরীক্ষা দেওয়া সম্ভব হয়নি সামিয়ার পক্ষে। সামিয়ার রক্তের অণুচক্রিকা (প্লাটিলেট) নেমেছে ৩৫ হাজারে। মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন তিনি। সামিয়াকে হাসপাতাল থেকে বাসায় নিয়ে যাওয়া হয় ২২ আগস্ট বিকেলে।

সামিয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে সরকারি বিজ্ঞান কলেজের অধ্যক্ষ এ বি এম রেজাউল করিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের কলেজের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের ল্যাবে বিশেষভাবে পরীক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। দৃষ্টিজয়ী শিক্ষার্থীরা সেখানে পরীক্ষা দিয়েছে। তাদের সঙ্গে মশারি টানিয়ে সামিয়া খানমের পরীক্ষার ব্যবস্থা হয়েছিল। ওর অভিভাবক তখন আমাদের শিক্ষকদের কক্ষে অপেক্ষা করেছেন। পরে জানলাম, মেয়েটি আর কন্টিনিউ করতে পারেনি। একজন শিক্ষার্থীর জীবন থেকে একটা বছর নষ্ট হয়ে গেল ডেঙ্গুর জন্য।’

২০ আগস্ট বাংলা দ্বিতীয় পত্র পরীক্ষার সময় বিশেষ ব্যবস্থার কক্ষে দায়িত্বে ছিলেন তেজগাঁও মহিলা কলেজের শিক্ষক রিফাত আরা। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘মেয়েটির বেশি সময় বসে থাকতে কষ্ট হচ্ছিল। অস্থির হয়ে যাচ্ছিল। ১০ মিনিট করে শুয়ে বিশ্রাম নিয়ে আবার লিখেছে। তারপরও ভালো পরীক্ষা দিয়েছে সে।’

অনেক সংগ্রামের মধ্যে পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়া শিক্ষার্থী সামিয়া আজ আবার অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। কিছুই খেতে পারছেন না। কিন্তু হাসপাতালে যেতে ভয় পাচ্ছেন বলে জানালেন তাঁর মা হালিমা বেগম।  প্রথম আলোকে তিনি বললেন, ‘আমাদের সংগ্রামের কথা তো বুঝেছেন। পরীক্ষা দেওয়া হলো না মেয়ের। এক সপ্তাহে ওজন কমতে কমতে বিছানার সঙ্গে মিশে গেছে। এখন শুধু চাই মেয়ে সুস্থ হোক।’

সামিয়া বলছিলেন, মশারির ভেতর তাঁর দম আটকে আসে। তাঁকে সঙ্গ দিতে সামিয়ার সঙ্গে মশারির ভেতর বসে থাকেন বড় বোন রূপা খানম। রূপা বললেন, ‘অসুস্থ হওয়ার পর থেকে আমার বোন আর কারও সঙ্গে কথা বলে না। কাউকে কাছে যেতে দেয় না। হাসপাতালে নেওয়ার সময় চারতলা থেকে কোলে করে নামিয়েছিলাম আমি। মশারির ভেতর ও ভয়ে আমার হাত আঁকড়ে শুয়ে থাকে।’

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023 EU BANGLA NEWS