রাজশাহীতে নিরুত্তাপ ভোটেও ভালো উপস্থিতি, ভোগান্তি ইভিএমে

রাজশাহীতে নিরুত্তাপ ভোটেও ভালো উপস্থিতি, ভোগান্তি ইভিএমে

রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ভোট গ্রহণ শান্তিপূর্ণভাবে শেষ হয়েছে। সকাল থেকেই অধিকাংশ কেন্দ্রে ভোটারদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। নৌকা ছাড়া মেয়র পদের অন্য কোনো প্রার্থীর এজেন্ট ছিলেন না। তবে ইভিএমে ভোট গ্রহণ জটিলতার কারণে ভোগান্তিতে পড়তে হয় ভোটারদের। ধীরগতির কারণে নির্ধারিত সময়ের পরও কিছু কেন্দ্রে ভোট নিতে দেখা গেছে।

আজ বুধবার সকাল ৮টা থেকে রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ভোট গ্রহণ শুরু হয়। সকাল থেকেই কেন্দ্রগুলোতে ভোটারদের উপস্থিতি ছিল তুলনামূলক ভালো। এর মধ্যে বেলা ১১টা ৫ মিনিটে হালকা বৃষ্টি শুরু হয়। সোয়া ১১টা থেকে মুষলধারে নামা বৃষ্টি চলে ঘণ্টাখানেক। বৃষ্টির কারণে কেন্দ্রগুলোতে উপস্থিতি কিছুটা কমে যায়। ঘণ্টাখানেক পর বৃষ্টি থামায় আবার ভোটাররা কেন্দ্রে আসেন।

প্রথম আলোর ৫ জন প্রতিবেদক ও ২ জন ফটোসাংবাদিক আজ সকাল থেকে রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেন। তাঁরা ১২টি ওয়ার্ডের ২৩টি ভোটকেন্দ্র ঘুরে দেখেন। এবার রাজশাহী সিটির ৩০টি ওয়ার্ডে ভোটকেন্দ্র রয়েছে ১৫৫টি৷

উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো

মেয়র পদে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা না থাকায় এবারের নির্বাচনে ভোটার উপস্থিত করা ছিল চ্যালেঞ্জের। ভোটার উপস্থিতি অনেকটাই নির্ভর করছিল ৩০টি ওয়ার্ডে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী ১১২ জন কাউন্সিলর প্রার্থীর ওপর। আজ সকাল থেকেই ভোটারদের কেন্দ্রে আনতে তৎপর ছিলেন কাউন্সিলর প্রার্থীরা।

সকাল ৭টা ৫০ মিনিটে শাহ মখদুম কলেজে গিয়ে দেখা, ভোট গ্রহণ শুরুর আগেই কেন্দ্রের সামনে ভোটারদের দীর্ঘ লাইন। বিশেষ করে নারী ভোটারদের।  নারী কেন্দ্রের প্রতিটি কক্ষের সামনেই ২৫ থেকে ৩০ জন দাঁড়িয়ে আছেন। কেন্দ্রের মূল ফটকের বাইরেও ভোটারদের সারি।

রাজশাহী সিটি করপোরেশনের ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের এ  এইচ এম কামারুজ্জামান বিভাগীয় স্টেডিয়ামে (ইনডোর) দুটি ভোটকেন্দ্র। এর মধ্যে একটি কেন্দ্রে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত ভোট পড়ে ৩৩ শতাংশ, আরেকটি কেন্দ্রে ২৬ শতাংশ। দুই কেন্দ্রের নির্বাচনী কর্মকর্তারা বলেন, মাঝে বৃষ্টির কারণে কেন্দ্রে ভোটার ছিলেন না। পরে আবার আসতে শুরু করেন।

রাজশাহী সিটি নির্বাচনে মেয়র পদের প্রার্থী ছিলেন চারজন। চারজনের মধ্যে ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী মুরশিদ আলম আগেই নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান। জাতীয় পার্টির মেয়র প্রার্থী সাইফুল ইসলাম এবং জাকের পার্টির মেয়র প্রার্থী লতিফ আনোয়ার প্রচারে সেভাবে নামেননি। শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকলেও ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী এ এইচ এম খায়রুজ্জামান ব্যাপক প্রচার চালিয়েছেন।

এবার রাজশাহী সিটি নির্বাচনে মোট ভোটার ৩ লাখ ৫১ হাজার ৯৮২ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ১ লাখ ৭১ হাজার ১৬৭ এবং নারী ১ লাখ ৮০ হাজার ৮০৯ জন।
এবার রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনে নতুন ভোটার ৩০ হাজার ১৫৭ জন। তাঁদের অনেকেই প্রথমবার ভোট দেন। মির্জাপুর স্কুল কেন্দ্রে ভোট দেন অর্না রানী। তিনি বলেন, জীবনের প্রথম ভোটটা ঠিকঠাক দিতে পেরেছি। একটা অন্য রকম অভিজ্ঞতা।

ইভিএমে ভোগান্তি, ক্ষুব্ধ ভোটাররা

রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনে এবারেই প্রথম সব কেন্দ্রে ইভিএমে ভোট দিয়েছেন ভোটাররা। একেকজন ভোটারের ইভিএমে ভোট দিতে সময় বেশি লাগে। আঙুলের ছাপ মেলাতেও সমস্যায় পড়তে হয়। ভোট দিতে দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছিল। অনেক কেন্দ্রে উপস্থিতির তুলনায় ভোট পড়ার হার ছিল কম। ইভিএম নিয়ে অপেক্ষমাণ ভোটাররাও ছিলেন ক্ষুব্ধ।

২৩ নম্বর ওয়ার্ডের শাহ মখদুম কলেজের নারী কেন্দ্রে ভোটার ১ হাজার ৬৬০ জন। প্রথম দেড় ঘণ্টায় এই কেন্দ্রে ভোট পড়ে ১০৪টি, যা মোট ভোটের সাড়ে ৬ শতাংশের মতো। এই কেন্দ্রের ৫ নম্বর ভোটকক্ষের সামনে অপেক্ষমাণ ছিলেন সেখের চক এলাকার ভোটার আজমিন মৌ। তিনি বলেন, ‘দেড় ঘণ্টা ধরে লাইনে আছি। এই মেশিনের ভোট বাংলাদেশের জন্য না। একজন ৬-৭ মিনিটেও ভোট দিতে পারছেন না।’

ইভিএমে ধীরগতির কারণে রাজশাহী সিটি করপোরেশনের ২৯ নম্বর ওয়ার্ডের ডাঁশমারী উচ্চবিদ্যালয়ের একটি কেন্দ্রে নির্ধারিত সময়ের পরও ভোট নিতে দেখা যায়। কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা নুর হোসেন বলেন, তাঁর কেন্দ্রে ৩ হাজার ১৪৭ ভোট। এর মধ্যে বিকেল চারটা পর্যন্ত ভোট পড়েছে ২ হাজারের বেশি। আরও কিছু ভোটার আছেন। দ্রুতই শেষ হয়ে যাবে।

দুই কাউন্সিলর প্রার্থীর কর্মীদের সংঘর্ষ

অধিকাংশ ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের একাধিক প্রার্থী এবং বিএনপি-জামাতের কাউন্সিলর প্রার্থী থাকায় সংঘাতের আশঙ্কা ছিল বেশি। তবে নির্বাচনের দিন ভোটের মাঠ ছিল মোটামুটি শান্ত। শুধু একটি কেন্দ্রে দুজন কাউন্সিলর প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের সংঘর্ষ হয়।

দুপুর ১২টার দিকে ৪ নম্বর ওয়ার্ডের দুই কাউন্সিলর প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। ক্ষণস্থায়ী এই সংঘর্ষে নগরের ভেড়িপাড়া মোড়ে কেশবপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রের সামনে রণক্ষেত্রের মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দ্রুত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।

এই দুই কাউন্সিলর প্রার্থী হচ্ছেন ৪ নম্বর ওয়ার্ডের বর্তমান কাউন্সিলর ও এবারের প্রার্থী রুহুল আমিন। তিনি ওয়ার্ড বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক। তিনি আওয়ামী লীগে যোগদান করলেও কোনো পদে নেই। তাঁর প্রতিপক্ষ ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি আশরাফুল ইসলাম।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, রাজশাহী পিটিআই কেন্দ্রের পাশে আশরাফুল ইসলামের নির্বাচনী ক্যাম্পে কে বা কারা হামলা করে চেয়ার ভাঙচুর করেন। এই অভিযোগে দুপুর ১২টার দিকে তাঁর সমর্থকেরা কেশবপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের দক্ষিণ পাশে রুহুল আমিনের একটি নির্বাচনী ক্যাম্পে হামলা করেন। উভয় পক্ষের মধ্যে মারপিট লেগে যায়। ইটপাটকেল নিক্ষেপ ও চেলাকাঠ নিয়ে দুই প্রার্থীরা সমর্থকেরা পরস্পরের প্রতি ধাওয়া করেন।

দুই মেয়র প্রার্থীর কোলাকুলি

রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী এ এইচ এম খায়রুজ্জামান সকাল সোয়া নয়টায় নগরের স্যাটেলাইট টাউন হাইস্কুল কেন্দ্রে দুই মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে ভোট দেন। পরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, এই নির্বাচনে অংশ না নিয়ে বিএনপি ভুল করেছে।

জাতীয় পার্টির প্রার্থী সাইফুল ইসলাম সকাল ১০টায় আটকোষী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট দিতে আসেন। জাতীয় পার্টির প্রার্থী সাইফুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, তিনি এখন পর্যন্ত পাঁচটি কেন্দ্রে ঘুরেছেন। সবগুলো কেন্দ্রে ইভিএমে খুব ধীরগতিতে ভোট গ্রহণ চলছে। ঘন্টায় ১৩ থেকে ১৪ টির বেশি ভোট নিতে পারছে না ইভিএম।

হঠাৎ আটকোষী বিদ্যালয় কেন্দ্রে হাজির হন আওয়ামী লীগের প্রার্থী খায়রুজ্জামান। এরপর দুই প্রার্থী একে অপরকে আলিঙ্গন করেন। সে সময় ২ জনই ভোটের পরিস্থিতি নিয়ে গণমাধ্যমে কথা বলেন। সাইফুল ইসলাম  বলেন, আমরা চাচা-ভাতিজা। ভোটের মাঠে আমরা প্রতিদ্বন্দ্বী। ভোটের বাইরে আমাদের সম্পর্ক সম্পর্কের মতোই থাকবে।

৫০ শতাংশের আশপাশে ভোট ২২ নম্বর ওয়ার্ডের রাজশাহী ভোলানাথ বিশ্বেশ্বর হিন্দু একাডেমি পুরুষ কেন্দ্রে বেলা সাড়ে তিনটায় ভোট পড়েছে ৫১ শতাংশের বেশি। তখন পর্যন্ত এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নারী কেন্দ্রে ভোট পড়েছে ৪০ শতাংশ। ভোট গ্রহণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ধারণা, এবার রাজশাহী সিটি নির্বাচনে ৫০ শতাংশের আশপাশে ভোট পড়েছে।

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023 EU BANGLA NEWS