মুহূর্তে আনন্দ রূপ নিলো বিষাদে
বাংলাদেশ অটোমোবাইল ওয়ার্কশপ মালিক সমিতির বার্ষিক এজিএম ও পিকনিক ছিল শুক্রবার (২১ ফেব্রুয়ারি)। রাজধানীর বিভিন্ন জায়গার মতো খিলগাঁও তালতলা মার্কেটের পাশের গ্যারেজ পট্টির ওয়ার্কশপের মালিক-কর্মচারীরাও যান সেই পিকনিকে।পূর্বাচলের ‘স্বপ্নকানন’ রিসোর্টে সারাদিন হৈহুল্লোড় শেষে যখন তারা ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তখনই মোবাইল ফোনে খবর পান তাদের ওয়ার্কশপে আগুন লাগার। মুহূর্তেই তাদের আনন্দ রূপ নেয় বিষাদে।
আগুনের খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পিকনিক স্পট থেকে যে যার মতো ওই গ্যারেজ পট্টিতে ছুটে আসেন ওয়ার্কশপগুলোর মালিক-কর্মচারীরা। কিন্তু ততক্ষণে সর্বনাশ হয়ে গেছে। নিজেদের চোখের সামনেই আগুনে পুড়তে থাকে তাদের জীবন-জীবিকার একমাত্র সম্বলটুকু। অগ্নিকাণ্ডের শুরুতে ওই গ্যারেজ পট্টি থেকে কয়েকটি গাড়ি আশপাশের মানুষজন বের করতে পারলেও আগুন ছড়িয়ে পড়ার পর আর কিছুই বের করা যায়নি। পুড়ে ছাই হয়ে যায় ওয়ার্কশপগুলোতে থাকা বিভিন্ন মানুষের দামি গাড়িসহ ওয়ার্কশপের সব মালামাল।
শুক্রবার (২১ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে খিলগাঁওয়ের তালতলা মার্কেটের পাশে গ্যারেজপট্টিতে আগুন লাগার খবর পায় ফায়ার সার্ভিস। সন্ধ্যা ৭টা ৩৫ মিনিটে ফায়ার সার্ভিসের প্রথম ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছে আগুন নেভানোর কাজ শুরু করে। এরপর একে একে যোগ দেয় আরও ৮টি ইউনিট। আগুনে ওয়ার্কশপগুলোতে থাকা গাড়ি পুড়ে বিকট শব্দে সেগুলোর সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হতে থাকে। ঘটনার ভয়াবহতায় ফায়ার সার্ভিসের আরো দুইটি ইউনিট ঘটনাস্থলে পাঠানো হয়। কিন্তু ওই দুই ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর আগেই আগুন নিয়ন্ত্রণে সেগুলো ফেরত পাঠানো হয়। প্রায় দুই ঘণ্টার চেষ্টায় রাত ৯টা ৩৫ মিনিটে ভয়াবহ সেই আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা।
আগুন নিয়ন্ত্রণের পর ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক (অপারেশন ও মেনটেনেন্স) লে. কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী জানিয়েছিলেন, আগুনে ২০টি দোকান ও দুইটি করাতকল পুড়ে গেছে।
শনিবার (২২ ফেব্রুয়ারি) সরেজমিনে খিলগাঁও তালতলা মার্কেটের পাশের সেই গ্যারেজ পট্টিতে গিয়ে দেখা যায়, আগুনে ওয়ার্কশপগুলোতে থাকা ২৪টি গাড়ি পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। এর মধ্যে ১৭টি মাইক্রোবাস ও প্রাইভেটকার এবং ৭টি মোটরসাইকেল। প্রাইভেটকার ও মাইক্রোবাসগুলো মেরামতের জন্য রাখা ছিল। আর মোটরসাইকেলগুলোর বেশিরভাগই সেসব গ্যারজ মালিক ও কর্মচারীদের। বাংলাদেশ অটোমোবাইল ওয়ার্কশপ মালিক সমিতির বার্ষিক এজিএম ও পিকনিকে ভিডিও করতে যাওয়া এক ব্যক্তির মোটরসাইকেলও এ আগুনে পুড়ে গেছে।
এছাড়া ওয়ার্কশপগুলোর বিভিন্ন মেশিনারিজও পুড়ে গেছে। দুইটি করাতকলের কাঠও পুড়ে কয়লা হয়ে গেছে। জীবন-জীবিকার একমাত্র সম্বল হারিয়ে ওয়ার্কশপ মালিকদের অনেকে নির্বিকার হয়ে গেছেন। কেউ আবার আহাজারি করে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ছেন, কেউ মাথায় হাত দিয়ে বসে আসেন। কর্মচারীরা পোড়াস্তূপ সারানোর কাজ করছেন।
আগুনে পুড়ে যাওয়া গ্যারেজ পট্টিতে ছিল হাকিম মোটরস। তিন বছর আগে হাকিমের মৃত্যুর পর থেকে তার স্ত্রী শিরিন ওই ওয়ার্কশপটি দেখাশোনা করতেন। পুড়ে যাওয়া সেই গ্যারেজেই আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে বসে থাকতে দেখা যায় শিরিনকে। কিছুক্ষণ পর পরই তিনি কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন এবং জ্ঞান হারাচ্ছিলেন। সবাই তার মাথায় পানি ঢালছে, বাতাস করছে। জ্ঞান ফিরেই আবার আহাজারি শুরু করছেন তিনি।
শিরিনের ভাই আনোয়ার বাংলানিউজকে বলেন, বোন জামাইর মৃত্যুর পর আমরাই ওয়ার্কশপটি দেখভাল করতাম। গতকাল আমরা সবাই মালিক সমিতির পিকনিকে ছিলাম। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে এলাকা থেকে ফোনে জানানো হয় গ্যারেজে আগুন লেগেছে। দ্রুত আমরা পূর্বাচল থেকে রওনা হই। কীভাবে যে আমরা সেখান থেকে আসছি, এটা শুধু আমরাই জানি। কিন্তু এসে কোনো লাভ হয়নি। রাত ৯টার দিকে যখন আমরা এসে পৌঁছাই তখন সব শেষ হয়ে গেছে। আমাদের ওয়ার্কশপেই ৬টি গাড়ি পুড়ে গেছে। একটি গাড়ির নাম্বার পর্যন্ত এখনো হয়নি।
তিনি আরও জানান, আগুনে তাদের গ্যারেজের প্রায় ২ থেকে আড়াই কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ক্যাশে থাকা ৩ লাখ টাকা পুড়েছে। এ গ্যারেজের ওপরেই আমাদের পরিবারের জীবিকা চলতো। এখন তো সব শেষ। আমরা যে কীভাবে চলবো, গাড়ির মালিকদের কী জবাব দিবো কিছুই বুঝছি না।
বাংলাদেশ অটোমোবাইল ওয়ার্কশপ মালিক সমিতির খিলগাঁও, শাহজাহানপুর, সবুজবাগ ও মুগদা থানা আঞ্চলিক কমিটির সভাপতি মো. মাসুম শিকদারেরও একটি ওয়ার্কশপ ছিল এ গ্যারেজ পট্টিতে। মাসুম অটো ওয়ার্কশপ নামের সেই ওয়ার্কশপটিও পুড়ে ছাই হয়ে গেছে আগুনে।
মো. মাসুম শিকদার বাংলানিউজকে বলেন, আমরা গতকাল সকাল ৭টার দিকে এ অঞ্চলের সব ওয়ার্কশপের মালিক পিকনিকে চলে যায়। সন্ধ্যা ৭টার দিকে আমরা খবর পাই আমাদের ওয়ার্কশপে আগুন লাগছে। আমরা দৌড়ে সবাই যে যার মতো গাড়ি নিয়ে এখানে আসছি। কিন্তু এসে কিছুই পাইনি। সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। প্রথমে কোণায় একটি গ্যারেজে আগুন লেগেছে। পরে ধীরে ধীরে অন্যগুলোতে আগুন ছড়িয়ে পড়ে।
তিনি আরও বলেন, ওয়ার্কশপ বন্ধ থাকায় আমাদের সব মেশিনারিজ বন্ধ ছিল। তারপরও কিভাবে যে আগুন লাগলো সেটা বুঝছি না। আমরা ওয়ার্কশপে প্রায় ২ কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হয়েছে। এই ওয়ার্কশপই আমার আয়ের উৎস্য ছিল। এখন পরিবার নিয়ে কিভাবে ঘুরে দাঁড়াবো বুঝছি না। আল্লাহকে ডাকা ছাড়া আমাদের আর কিছু করার নেই।
ব্যক্তিগত কারণে ওই পিকনিকে যেতে পারেননি বাংলাদেশ অটোমোবাইল ওয়ার্কশপ মালিক সমিতির খিলগাঁও, শাহজাহানপুর, সবুজবাগ ও মুগদা থানা আঞ্চলিক কমিটির অর্থ সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম।
তিনি বলেন, আগুন লাগার খবর পেয়েই আমি ছুটে আসি। একপাশে যখন আগুন জ্বলছিল, তখন আমরা ৪টি গাড়ি বের করতে পারি। এরপর আগুন ছড়িয়ে পড়লে আর কোনো গাড়ি বের করতে পারিনি।
ফায়ার সার্ভিসের গাফিলতির অভিযোগ করে তিনি আরও বলেন, প্রথমে যখন একটি ওয়ার্কশপে আগুন লাগে তখন ফায়ার সার্ভিসের যে গাড়ি আসছিল, সেটিতে বেশি পানি ছিল না। কিছুক্ষণ পরেই পানি শেষ হয়ে যায়। এরপর যেটি আসে, সেটির পাইপ ফাটা ছিল, পানি পাইপ দিয়েই বের হয়ে যাচ্ছিল। পরে আরও গাড়ি এসে আগুন নেভায়। কিন্তু প্রথমেই ঠিকভাবে আগুন নেভানোর চেষ্টা করলে আমাদের এ সর্বনাশ হতো না।
এ ওয়ার্কশপে গাড়ি মেরামত করতে দিয়েছিলেন জাহিদ নামে এক গাড়ি ব্যবসায়ী। কয়েকদিন আগে ২২ লাখ টাকা দিয়ে এক্স নোহা মডেলের একটি মাইক্রোবাস সেকেন্ড হ্যান্ড কিনেন তিনি। সে গাড়িও আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। জাহিদ বলেন, আগুন খবর পেয়ে আমি গ্যারেজে আসি। ওয়ার্কশপ বন্ধ থাকায় আমার গাড়িটা বের করতে পারিনি। গ্রিল ধরে অনেক টানা টানি করেছি। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি।