‘প্রশ্নবিদ্ধ’ পরিসংখ্যানে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের যাত্রা, গোলকধাঁধায় অর্থনীতি

‘প্রশ্নবিদ্ধ’ পরিসংখ্যানে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের যাত্রা, গোলকধাঁধায় অর্থনীতি

এ বছর পেরোলে সামনের বছরই স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বের হয়ে যাবে বাংলাদেশ। উত্তরণ ঘটবে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে।বৈশ্বিক অর্থনীতির মাপকাঠিতে কোনো দেশ উন্নয়নশীল রাষ্ট্র হয়ে উঠলে আন্তর্জাতিক বাজারে স্বল্পোন্নত হিসেবে পেয়ে আসা সব সুবিধা হারায়। বাংলাদেশ অবশ্য গ্রেস টাইম হিসেবে আরও তিন বছর শুল্ক সুবিধা পাবে। এরপর স্বল্পোন্নত দেশের সব সুবিধা হারাবে। সেই সুবিধা হারানোর পর উন্মুক্ত বৈশ্বিক বাজারের সামনে দাঁড়াতে কতটা প্রস্তুত বাংলাদেশ? পরিবর্তিত অবস্থায় এখন নতুন করে সেই প্রশ্ন সামনে এসেছে।

স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের জন্য মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ উন্নয়ন ও অথনৈতিক ভঙ্গুরতার সূচকে উত্তীর্ণ হতে হয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) বলছে, তিন সূচকেই উত্তীর্ণ হয়ে দীর্ঘ সময় ধরেই তা বহাল আছে। এ কারণে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণে কোনো বাধা নেই।

ব্যবসায়ী নেতা ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এসব সূচকের উন্নয়ন হলেও এর পেছনের নিয়ামক যে অর্থনৈতিক সামর্থ্য প্রয়োজন তা নিয়ে সংশয় রয়ে গেছে। বিশেষ করে বিবিএসের প্রশ্নবিদ্ধ পরিসংখ্যান ও সূচকের ওপর ভিত্তি করে এই যাত্রায় গোলকধাঁধায় পড়ে যেতে পারে অর্থনীতি।

নিয়ম অনুসারে, স্বল্পোন্নত দেশ হিসাবে বাংলাদেশ যে সুবিধা পাচ্ছে, উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার পর সেগুলো হারাতে হবে। যেমন, স্বল্পোন্নত দেশ হওয়ায় বাংলাদেশ রফতানিতে বিশেষ ভর্তুকি দিয়ে থাকে। উন্নয়নশীল দেশে রূপান্তর ঘটলে রফতানিতে বিশেষ ভর্তুকি দেওয়ার সুযোগ থাকবে না।

স্বল্পোন্নত দেশ হওয়ায় জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় বাংলাদেশ উন্নত বিশ্ব থেকে সহায়তা পেয়ে  থাকে। উন্নয়নশীল দেশ হয়ে গেলে সে অর্থায়নও বন্ধ হবে।

স্বল্পোন্নত দেশ হওয়ায় জাতিসংঘকে কম চাঁদা দিতে হয়, উন্নয়নশীল দেশ হলেই চাঁদার হার দ্বিগুণ হবে। বিভিন্ন সভায় অংশ নিতেও চাঁদা দিতে হবে।  

স্বল্পোন্নত দেশ হিসাবে বাংলাদেশ জাপান, চীনসহ বিভিন্ন দেশ থেকে সরাসরি (অফিসিয়াল ডেভেলপমেন্ট অ্যাসিস্ট্যান্স-ওডিএ) যেসব ঋণ পায়, উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেলে এসব ঋণের শর্ত কঠিন হয়ে যাবে।

স্বল্পোন্নত দেশ হিসাবে বাংলাদেশ ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য ও কানাডাতে শুল্কমুক্ত পণ্য রপ্তানির সুবিধা পায়, ২০২৬ সালে সালে উন্নয়নশীল দেশে রূপান্তর ও গ্রেস টাইম হিসাবে আরও দুই বছর পর্যন্ত তা বহাল থাকবে। তবে ২০২৯ সাল থেকে সেই সুবিধা হারাবে এ দেশের রপ্তানিখাত। দেশেও এসব রপ্তানি পণ্যে সরকার যে ভর্তুকি দেয় তা বন্ধ করতে হবে। এতে দেশের রপ্তানিখাত বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার সক্ষমতা হারাবে বলে আশঙ্কা আছে শিল্পোদ্যোক্তাদের মনে।

তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সাবেক পরিচালক শোভন ইসলাম বলেন, দেশে রপ্তানি আয়ের ৮৫ শতাংশ আসে তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে। পর্যাপ্ত প্রস্তুতি ছাড়া স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণে তৈরি পোশাক রপ্তানি ঝুঁকিতে পড়বে। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশ যে সুবিধা হারাবে এতে ৩০ শতাংশ কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে।

তিনি বাংলানিউজকে বলেন, বাংলাদেশ তৈরি পোশাক রপ্তানিতে ভালো করলেও অবকাঠামোগত সড়ক, বন্দরের ক্ষেত্রে সমস্যা রয়েছে। গ্যাস-বিদ্যুৎ প্রাপ্তিতে সমস্যা আছে। গ্যাস-বিদ্যুতে বাড়তি দাম দিয়েও নিরবচ্ছিন্নভাবে পাওয়া যায় না। এর ফলে একদিকে লিট-টাইম বাড়ে, অন্যদিকে উৎপাদন ব্যয়ে বেড়ে যায়।

তৈরি পোশাক শিল্পে বাংলাদেশ ভালো করছে, রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধিও ভালো হচ্ছে। স্বল্পোন্নত দেশ হিসাবে আমরা ইউরোপ ও কানাডায় কোটামুক্ত বাজার সুবিধা পাচ্ছি। উন্নয়নশীল দেশ হলে আমরা সে সুবিধা হারাব। বর্তমান অবকাঠামোগত অবস্থায় উন্মুক্ত বিশ্ববাণিজ্য বাংলাদেশের জন্য কঠিন হয়ে পড়বে; বলেন এই উদ্যোক্তানেতা।  

সিডিপির শর্ত ও বিবিএসের সূচক
বিবিএস হচ্ছে অর্থনৈতিকসূচক নির্ণয়ক কর্তৃপক্ষ। এ প্রতিষ্ঠান বলছে, জাতিসংঘের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক কাউন্সিলের (ইসিওএসওসি) উন্নয়ন নীতিমালা বিষয়ক কমিটির (সিডিপি) শর্ত অনুযায়ী, স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে রূপান্তরে প্রথম মানদণ্ড হলো মাথাপিছু আয় ১,৩০৬ ডলার হতে হবে। বাংলাদেশ ২০২৪ সালে ২,৬৮৪ ডলার নিশ্চিত করেছে।

সিডিপির শর্ত অনুযায়ী, মানবসম্পদ উন্নয়নের সূচক হতে হবে ৬৬। বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ ২০২৪ সালে ৭৭.৫ সূচক নিশ্চিত করেছে। এ সূচকও আগের তিন বছরের গড়।

উন্নয়নশীল দেশে উত্তীর্ণ হওয়ার সূচক রয়েছে ৩২। বিবিএস বলছে, ২০২৪ সালে বাংলাদেশ ২১.৯ নিশ্চিত করেছে। পরপর তিন বছর এসব সূচক ধরে রেখেছে।

এই তিন সূচকের ভিত্তিতে ২০২৪ সালের ৪-৮ মার্চ সিডিপির ২৬তম অধিবেশনে বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশ হিসাবে মূল্যায়ন করে।

প্রদত্ত সূচকে সিডিপির শর্ত পূরণ হলেও বিবিএসের পরিসংখ্যান তথ্য নিয়ে নানা সময়ে প্রশ্ন উঠেছে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মহলে।

গত আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর বাংলাদেশের উন্নয়নচিত্র ও এ সংক্রান্ত তথ্য-পরিসংখ্যানে ভুলের বিষয়টি সামনে এসেছে। বিভিন্ন মহল থেকে প্রশ্ন তোলা হয়েছে, হাসিনা সরকার কৃতিত্ব নিতে বেশি বেশি উন্নয়ন দেখিয়েছে। আর এটা করতে অর্থনৈতিক সূচকগুলোকেও বাড়িয়ে দেখাতে ভুল তথ্যের ভিত্তিতে ‍নির্ণয় করেছে।  

গত জানুয়ারিতে সুইজারল্যান্ডে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের সম্মেলনের ফাঁকে রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে খোদ প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসই বলেন, ‘তিনি (হাসিনা) বলেছিলেন, আমাদের প্রবৃদ্ধির হার সবার চেয়ে এগিয়ে। এটা ভুয়া প্রবৃদ্ধি, একেবারেই ভুয়া। ’

তার আগে গত সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত এক জরিপ প্রতিবেদনেই বিবিএসের পরিসংখ্যানের নির্ভুলতা নিয়ে সন্দেহের বিষয়টি তুলে ধরা হয়।  ‘বিবিএসের তথ্য-উপাত্ত ব্যবহারকারীদের সন্তুষ্টি জরিপ প্রতিবেদন-ইউএসএস-২০২৪’ শিরোনামে প্রতিবেদনে বলা হয়, রিসংখ্যানের নির্ভুলতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন জরিপে অংশ নেওয়া প্রায় ২৬ শতাংশ ব্যবহারকারী। পরিসংখ্যানের সময়োপযোগিতার প্রশ্নে প্রায় ৩৯ শতাংশ ব্যবহারকারী অসন্তুষ্ট। ১৭ শতাংশ মনে করে বিবিএসের সব উপাত্তই প্রাসঙ্গিক নয়। পরিসংখ্যান প্রকাশের নিয়মিত বিরতির প্রশ্নেও খুশি নন ৪২ শতাংশ ব্যবহারকারী। আর বিবিএসের পরিসংখ্যানের মান নিয়ে খুশি নয় এমন ব্যবহারকারী রয়েছেন ১২ শতাংশ।

যা বলছেন অর্থনীতিবিদরা
এমন প্রশ্নবিদ্ধ তথ্যের ভিত্তিতে স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ হলে বাংলাদেশের অর্থনীতি গোলকধাঁধায় পড়তে পারে বলে আশঙ্কা বিশ্লেষকদের। সেজন্য বিষয়টি নিয়ে পর্যালোচনা করার তাগিদ দিয়েছেন তারা।  

এ বিষয়ে সরকারি প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, প্রধান উপদেষ্টার অফিসে এ বিষয়ে দক্ষ লোকজন আছেন, তাদের পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংকের এটা দেখা দরকার।  

তিনি বাংলানিউজকে বলেন, বিশ্বের যেসব দেশ স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল হয়েছে, তাদের সঙ্গে তথ্য পর্যালোচনা করা দরকার।

বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণে উপযুক্ত হয়েছে কি না, এটার পক্ষে-বিপক্ষে মতামত আছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

আবু আহমেদ বলেন, বাংলাদেশ এখন যেখানে দাঁড়িয়ে, এ অবস্থায় উন্নয়নশীল দেশ না হলেও ইমেজ সংকট তৈরি হবে কি না! আবার তথ্যেরও গরমিল আছে। বিষয়টি অর্থ মন্ত্রণালয়ের দেখা উচিত।

বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা, কম সুদের বৈদিশক ঋণ বা বিশেষ সহায়তা হারালে অবশ্যই সেটা আলোচনার বিষয়। তবে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ হওয়ার পথে যে শর্ত রয়েছে বাংলাদেশ তা সক্ষমতার সঙ্গে অতিক্রম করেছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ পরিসংখ্যন ব্যুরোর (বিবিএস) ডেপুটি ডিরেক্টর তোফায়েল আহমেদ।  

তিনি বাংলানিউজকে বলেন, তিনটি সূচকের মধ্যে দুটি সূচক পরপর তিন বছর অতিক্রম করলেই সেই দেশ উন্নয়নশীল হতে পারে। বাংলাদেশ সেখানে তিন বছর ধরেই তিনটি সূচকেই এগেয়ে আছে। এ হিসেবে উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার পথে কোনো বাধা নেই।

উন্নয়নশীল দেশের পথে মাথাপিছু আয়সহ সব সূচকে অগ্রগতির কথা বলা হচ্ছে, এগুলো ভুল নির্ণয় পদ্ধতিতে করা হয়েছে। ভুল নির্ণয় পদ্ধতির সূচকের ওপর দেশ উন্নয়নশীল হলেও টিকে থাকতে পারবে না, ব্যবসায়ী ও রাজনীতিকদের পক্ষ থেকেও এ কথা বলা হচ্ছে। এমন অবস্থায় উন্নয়নশীল দেশে উত্তীর্ণ হওয়া সঠিক হবে কি না, এ বিষয়ে পরিংখ্যন ব্যুরো কী ভাবছে, এমন প্রশ্নের জবাবে তোফায়েল আহমেদ বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্যের ভিত্তিতে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত স্ট্যান্ডার্ড সিসটেম অব ন্যাশনাল অ্যাকাউন্ট (এসএনএ) নির্ণয় পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। এ পদ্ধতি ভুল নয়। আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকও এসএনএ হিসাবায়ন পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন করতে পারেনি।

তিনি বলেন, হিসাবের পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন তোলা যাবে না। তবে সরকার মনে করলে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার জন্য আরও কিছুটা সময় চাইতে পারে। উপমহাদেশের অন্য একটি দেশও সময় চেয়েছে। বাংলাদেশও এ পথ অনুসরণ করতে পারে।

চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় করণীয়
তৈরি পোশাক শিল্পের উদ্যোক্তারা বলছেন, দেশ উন্নয়নশীল হওয়ার পর প্রধান আঘাতটি আসবে তৈরি পোশাক শিল্পের ওপর। তৈরি পোশাক ইউরোপ ও কানাডার বাজারে কোটামুক্ত সুবিধা হারাবে। সেক্ষেত্রে এ শিল্পর সক্ষমতা বৃদ্ধি, অবকাঠামোগত যোগাযোগ ও বন্দর সমস্যার সমাধান; গ্যাস-বিদ্যুৎ সরবারহ বৃদ্ধি; আইন-শৃঙ্খলার উন্নতি ও রাজনৈতিক অস্থিরতা দূর করে স্থিতিশীল পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।  

বাজার সুবিধা চলে যাওয়ার পর নিজস্ব সক্ষমতার ওপরই নির্ভর করতে হবে। উৎপাদনশীলতা, দক্ষতা, প্রযুক্তি নির্ভরতা এবং প্রতিযোগিতার সক্ষমতা তৈরি করা প্রয়োজন বলে মনে করেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান।  

তিনি বাংলানিউজকে বলেন, যদিও আমরা ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য ও কানাডাতে আরও তিনবছর বাজার সুবিধা পাবো। কিন্তু একটা সময় তো আসবে, তখন আমাদের সেই সুবিধা থাকবে না। তখন উৎপাদনশীলতা বাড়িয়ে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা অর্জন করতে হবে।

মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বাণিজ্য সহজীকরণ নিশ্চিত করতে হবে। পোর্টের সক্ষমতা বৃদ্ধি, সড়কের সমস্যা দূর এবং চাঁদাবাজি দূর করে সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। লজিস্টিক খরচ, ট্রান্সপোর্ট খরচ কমাতে হবে। এগুলো যদি আমরা কিছুটা কমাতে পারি তাহলে বাজার সুবিধা হারানোর ফলে যে ক্ষতি হবে, তা থেকে সেই ক্ষতি পূরণ করা সম্ভব হবে।

তিনি বলেন, ক্ষতি পুষিয়ে নিতে দেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাকের পণ্য ও বাজারের বৈচিত্র আনতে হবে। আবার অন্যান্য অ-প্রধান পণ্য চামড়া, পাট ও পাটজাত পণ্যের মত রপ্তানির সুবিধাগুলোও নিতে হবে।  

অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বাংলাদেশের চামড়ার তুলনামূলক মান ভালো, সারা বছর পশু জবাই করা ও ঈদুল আজহায় একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পশু কোরবানি করার কারণে একসঙ্গে বিপুল পরিমাণে চামড়া আসে। যে সুবিধা প্রতিবেশী ভারতেরও নেই। সেখানে গরুর জীবদ্দশা শেষ না হওয়া পর্যন্ত চামড়া সংগ্রহ করার সুবিধা নেই। যে কারণে সেখানে অনেক চামড়া নষ্ট হয়। সে হিসাবে বাংলাদেশের চামড়ার মান ভালো। কোটামুক্ত নতুন বিশ্ববাস্তবতায় দেশের এই চামড়া পরিকল্পিত ব্যবহারে মনোযোগ দিতে হবে।  

বিশ্ববাজারে চাহিদা থাকার পরও চামড়া খাতের বৈশ্বিক সংস্থা লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের (এলডব্লিউজি) সনদ না থাকার কারণে বাংলাদেশ টেকসই চামড়ার বাজারে প্রবেশ করতে পারছে না। এ সনদের জন্য বুড়িগঙ্গাকে দূষণ থেকে রক্ষা করতে হাজারীবাগের চামড়াশিল্প এলাকা সরিয়ে সাভারে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু একটি সেন্ট্রাল ইফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্লান্টের (সিটিপি) অভাবে ধলেশ্বরীর পাশাপাশি পরিবেশ দূষণ শুরু হয়েছে। ১০ বছর চেষ্টা করেও পরিবেশ সম্মত চামড়া শিল্প নগরী গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি।  

এ বিষয়ে লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (এলএফএমইএবি) সিনিয়র সহ-সভাপতি মোহাম্মদ নাজমুল হাসান বলেন, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের বাজার প্রসার হওয়ার ক্ষেত্রে এলডব্লিউজি সনদের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ।

আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডগুলোর কাছে ভালো দামে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য বিক্রি করতে হলে চামড়া খাতের বৈশ্বিক সংস্থা লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের (এলডব্লিউজি) সনদ থাকতে হয়, যা বাংলাদেশের মাত্র ছয়টি প্রতিষ্ঠানের রয়েছে। বাকিরা এ সুবিধা না নিতে পারায় চামড়া শিল্পের যে বিকাশের সম্ভাবনা রয়েছে সেটা কাজে লাগানো যাচ্ছে না। যে কারণে পরিবেশসম্মত কারখানাও গড়ে উঠছে না।  

ভুল তথ্যের ভিত্তিতে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ হচ্ছে, এমন কথা বলা হচ্ছে। তাহলে সেই তথ্য যে নীতির ভিত্তিতে তৈরি হয়েছে সেটাই পর্যালোচনা করার প্রয়োজন বলে মনে করেন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিআইএস-এর সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. বদরুন্নেসা আহমেদ।

তিনি বাংলানিউজকে বলেন, কোনো জিনিসের মৌল ভিত্তিকে নির্ভর করে যখন প্রমোশন দেবো তখন শর্তগুলোর ভ্যালিডিটিতে আগে গুরুত্ব দেওয়া দরকার।  

বদরুন্নেসা আহমেদ বলেন, অনেকে বলছেন বিবিএসের তথ্য রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত, ক্যালকুলেশনে ঝামেলা আছে; ক্যালকুলেশন স্ট্যান্ডার্ড না। যদি এটা প্রভাবিত তথ্য হয়ে থাকে তাহলে পর্যালোচনা করা যেতে পারে। বিবিএস-এর তথ্য প্রশ্নবিদ্ধ কেউ বললেও আমরা কিছু বলতে পারবো না। তাহলে বিকল্প কী হতে পারে, আন্তর্জাতিকভাবে যে স্ট্যান্ডার্ডগুলো অনুসরণ করে জীবনযাত্রার মান নির্ণয় করা হয় সেই পদ্ধতিটা ব্যবহার করে দেখতে হবে।

বিবিএসের স্ট্যান্ডার্ড যদি ভুল হয় তাহলে এই স্ট্যান্ডার্ডের ভিত্তিতে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাও ভুল হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ভুল তথ্যের ভিত্তিতে স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশ করে দিলে স্নাতকোত্তর পরবর্তী যে ক্যাপাসিটি হওয়ার দরকার তা থাকবে না। তখন সত্যিকারের উত্তরণ ঘটবে না। তাই প্রসেসটা সঠিক ও স্বচ্ছ হওয়ার দরকার।

এই গবেষক বলেন, যখন আমাদের সুবিধাগুলো চলে যাবে, তখন পোশাক শিল্প, সেবা খাতগুলো উন্মুক্তবাজার ব্যবস্থায় টিকে থাকতে পারবে কি না! ভুল তথ্যের ভিত্তিতে উত্তরণ ঘটলে প্রতিযোগী দেশগুলোর সঙ্গে আমরা টিকতে পারবো না।

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023 EU BANGLA NEWS