হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে সেতু করে নদী মেরে ফেলার চেয়ে নৌপথ সস্তা করাই আধুনিক পরিবেশসম্মত চিন্তা। ব্রহ্মপুত্রে টানেল বা সেতু করলে পদ্মা সেতুর অভিজ্ঞতা বলে, লাখো কোটি টাকার নিচে হবে না। এতে নদীও মরে, রাষ্ট্রকেও ঋণের বোঝা টানতে হয় দীর্ঘদিন। তার চেয়ে ঘাটের ইজারা তুলে দিলেই যাত্রীদের স্বাধীনতা বেড়ে যায় অনেক গুণ। পারাপারের ভাড়া শতকরা ১০ ভাগে নেমে আসে। রাষ্ট্রকেও বাড়তি কোনো খরচ করতে হয় না। নৌপথে সস্তায় পণ্য পরিবহনও বাড়ে।
তাই এ অঞ্চলের মানুষের দীর্ঘদিনের দাবি চিলমারী টু রৌমারী রুটে ফেরি চলাচলের। গণকমিটি নামের একটি সংগঠনও দীর্ঘদিন এই দাবি জানিয়ে আসছে। এই ফেরি চালু হলে লালমনিরহাট, রংপুর, পঞ্চগড় ও কুড়িগ্রামের যাত্রীরা বাসে চড়েই যানজটমুক্তভাবে পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টায় রাজধানীতে পৌঁছাবেন। এতে এমনকি তিস্তা নদীর ওপর নির্মাণাধীন চিলমারী-হরিপুর সেতু পর্যন্ত অকার্যকর হয়ে যাবে। সবাই ফেরিকেই অগ্রাধিকার দেবে। কারণ, চিলমারী-হরিপুর সেতুর সংযোগ সড়কটি গাইবান্ধা অংশে পুনরায় পলাশবাড়ীতে গিয়ে যুক্ত হয়েছে। এতে দূরত্ব কমেছে বড়জোর ৫০ কিলোমিটার। কিন্তু এই ফেরিতে দূরত্ব কমবে কমপক্ষে দেড় শ কিলোমিটার। এই অঞ্চলের জীবনযাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
২.
‘ওকি গাড়িয়াল ভাই, হাঁকাও গাড়ি তুই চিলমারীর বন্দরে রে’। কয়েক শ বছরের পুরোনো একটি ভাওয়াইয়া এটি। আব্বাসউদ্দীন আহমদের গলা ধরে গানটি পরবর্তী যুগে প্রবেশ করেছে। যে জেলা বোর্ডের সরলরেখার মতো সোজা সড়ক ধরে আব্বাসউদ্দীন আহমদ চিলমারী বন্দরে এসে পৌঁছেছিলেন, শত শত বছরেরও আগ থেকে এ সড়ক ছোট পাঁচ থেকে ছয়টি নদ–নদী অতিক্রম করে ব্রহ্মপুত্রতীরে চিলমারী নদীবন্দরে গিয়ে পৌঁছেছে। কবিশেখর কালিদাস রায় তাঁর স্মৃতিকথায় উলিপুর যাত্রা (১৯১৩-২০) অংশে লিখেছেন, ‘কুড়িগ্রাম থেকে উলিপুর যত দূর, উলিপুর থেকে চিলমারী তত দূর।’ অর্থাৎ কুড়িগ্রাম থেকে উলিপুর যেমন ১৮ কিলোমিটার, তেমনি উলিপুর থেকে চিলমারীর দূরত্বও ১৮ কিলোমিটার। কিন্তু বর্তমানে উলিপুর থেকে চিলমারীর দূরত্ব ১২ কিলোমিটার। মানে ৬ কিলোমিটার ব্রহ্মপুত্রের পেটে। সম্প্রতি চিলমারীর মাটিকাটা থেকে সোজা রমনাঘাট পর্যন্ত প্রায় ৩০ কোটি টাকা ব্যয়ে সিসি ঢালাইসম্পন্ন সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে।
অতি সম্প্রতি বাংলাদেশের বেশ কিছু নদীবন্দর ব্যর্থতায় পরিণত হয়েছে। একটি বন্দর সফল হওয়ার বেশ কিছু কারণ আছে। তার মধ্যে প্রধান দুটি কারণ হলো—এক. নাব্যতা, দুই. সংযোগ সড়ক।
চিলমারী থেকে মূলত দুটি ঘাট থেকে রৌমারী যাতায়াত হয়। রমনাঘাট থেকে ঘণ্টায় ঘণ্টায় নৌকা চলাচল করে। এর বাইরে রিজার্ভেও আলাদা নৌকা চলে। আর ফকিরেরহাট ঘাট থেকে সারা দিনে একবার চলাচল করে। কারণ এখানে দুটোই।
চিলমারীর রমনা থেকে রৌমারী রুটে সারা বছরই নাব্যতা থাকে। ফলে কখন পানি কমে যায়—এ দুশ্চিন্তা থাকে না। অন্যদিকে, ফকিরেরহাট ঘাটে এই দুশ্চিন্তা আছে।
এ ছাড়া কুড়িগ্রাম থেকে বিশাল চওড়া জেলা বোর্ডের সড়ক। এটি সোজা নাকবরাবর গিয়েছে রমনাঘাটে। এমনকি বন্দর কার্যক্রম পরিচালনার জন্য মাটিকাটা নামক স্থান থেকে রমনাঘাট পর্যন্ত সড়কটি ৩০ কোটি টাকা ব্যয়ে সিসি ঢালাই করা হয়েছে। কিন্তু ফকিরেরহাট ঘাটে জেলা সড়ক থেকে মাত্র অটোরিকশা চলাচলের উপযোগী একটি বহু বাঁকবিশিষ্ট সরু সড়ক চলে গিয়েছে। যেটি একটি দুর্ঘটনাপ্রবণ সড়কও বটে। বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান পরিদর্শনকালে তা নিশ্চয়ই খেয়াল করেছেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী অন্যতম তিনটি কারণ হচ্ছে—সড়কের বিন্যাস, পরিকল্পনা ও পরিবেশ। একই কারণে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে আজ পর্যন্ত বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু ফকিরেরহাটমুখী সড়ক তা নয়।
৩.
গত ৩১ মে বিআইডব্লিটিএর মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) জেসমিন আরা বেগম স্বাক্ষরিত চিঠিতে জানা গেছে, বিআইডব্লিটিএর (একজন অতিরিক্ত সচিব মর্যাদার) চেয়ারম্যান এস এম ফেরদৌস আলম ২ জুন সকাল ১০টায় চিলমারীর সম্ভাব্য ফেরিঘাট এলাকা পরিদর্শন ও স্থানীয় মানুষের সঙ্গে আলাপ–আলোচনা করবেন।
এর পরিপ্রেক্ষিতে এস এম ফেরদৌস আলম পরিদর্শন করেন রমনাঘাট। তাঁর সঙ্গে ছিলেন একটি কারিগরি দলও। তাঁরা নিশ্চয়ই উপযুক্ত সিদ্ধান্ত নেবেন। কিন্তু তাঁরা যে সময় ঘাট দুটি পর্যবেক্ষণ করলেন, এতে সড়কের তফাতটা বুঝলেও নাব্যতাটি বুঝবার কথা না।
কেউ কেউ নাকি কুযুক্তি দেখাচ্ছেন, বিদেশি জাহাজগুলো রমনাঘাটে ভিড়বে ভবিষ্যতে, তখন জায়গার সংকট হবে। সবই ভবিষ্যৎ। বাকির লোভে নগদ পাওনা ছাড়তে বলছেন—বিদেশি জাহাজের আশায় লাভজনক রুটকে ত্যাগ করা। বরং সচল রমনাঘাটকে আরও সচল আরও ব্যবসাবান্ধব করতে রমনাঘাট থেকে ফেরি চলাচল করা উচিত। একটা রুটকে জনপ্রিয় করতেও তো সময় লাগে।
বাংলাদেশে কোনো সিদ্ধান্ত জনগণের স্বার্থের কথা বিবেচনা করে নেওয়া হলে উড়ালসড়কগুলোর এই দশা হতো না। যমুনায় আলাদা করে রেলসেতু হয় না। নেতা বা কর্মকর্তার বাড়ি, স্বজনপ্রীতি নীতিনির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মন্ত্রী কোটায় চাকরি হয়, উন্নয়ন হয়। ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক নির্মাণের সময়ও নাকি একই ঘটনা ঘটেছিল পাকিস্তান আমলে। চিলমারীতে ফেরিঘাট কোথায় হবে, এটা নিয়ে ফেসবুকে এ রকম একটি আশঙ্কামূলক পোস্ট ঘুরে বেড়াচ্ছে। আশা রাখি, সব আশঙ্কা দূরীভূত হয়ে ব্যস্ত ও লাভজনক একটি ফেরিঘাট বাংলাদেশ পাবে।
nahidknowledge1@gmail.com