৪৩তম বিসিএস: ৫ বছরের অপেক্ষার পর ১৮৯৬ জন চাকরিতে, ২২৭ জন সংবাদ সম্মেলনে

৪৩তম বিসিএস: ৫ বছরের অপেক্ষার পর ১৮৯৬ জন চাকরিতে, ২২৭ জন সংবাদ সম্মেলনে

দীর্ঘ পাঁচ বছরের অপেক্ষা শেষে ৪৩তম বিসিএসে নিয়োগ পাওয়া বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের বিভিন্ন ক্যাডারের ১ হাজার ৮৯৬ জন প্রার্থী আজ বুধবার চাকরিতে যোগ দিয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে চাকরিতে যোগ দেওয়ার পোস্ট দিয়ে শুভেচ্ছায় সিক্ত হচ্ছেন তাঁদের অনেকেই। এই ব্যাচের বাকি ২২৭ জন প্রার্থীর জন্যও আজকের দিনটি আনন্দের হতে পারত। কিন্তু গেজেট থেকে বাদ পড়ায় নিয়োগের দাবিতে আজ সংবাদ সম্মেলন করেছেন তাঁরা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে আজ বিকেলে সংবাদ সম্মেলনে আসা ৪৩তম বিসিএসের গেজেট থেকে বাদ পড়া কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। কান্নাজড়িত কণ্ঠে মো. ফয়সাল চোকদার বলেন, ‘আজকের দিনটি আমার পরিবারের জন্য সবচেয়ে আনন্দের হতে পারত। কিন্তু গতকাল রাত থেকে শুধু কেঁদে যাচ্ছি। বিসিএসের দীর্ঘ যাত্রা প্রিলিমিনারি, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় পাস করে পাঁচ বছর পর যখন চাকরিতে যোগদান করতে যাব, তখন আমাকে কোনো কারণ ছাড়াই বাদ দেওয়া হলো।’

একটি সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে নন-ক্যাডার চাকরিতে কর্মরত ছিলেন মো. ফয়সাল চোকদার। ৪৩তম বিসিএসের প্রথম গেজেটে নাম আসায় সেই চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে এখন বেকার। মো. ফয়সাল চোকদার বলেন, ‘আমি শুধু ৪৩তম বিসিএস না, ৪৪তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছি এবং ৪৫তম ও ৪৬তম বিসিএসের প্রিলিমিনারিতে উত্তীর্ণ হয়েছি। ৪৩তম বিসিএসের গেজেট থেকে বাদ পড়ায় আমার সামনে যে ৪৪তম বিসিএসের ভাইভা আছে, সেখানে ভাইভায় ভালো করলেও আমার বাদ পড়ার আশঙ্কা আছে। যেখানে আজ আমার ব্যাচমেটদের সঙ্গে সরকারি চাকরিতে যোগ দিয়ে দেশসেবা করার কথা, সেখানে এখন আমার জীবন চরম এক অনিশ্চতায়।’ তিনি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে কোনো রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা ছিল না। রাজনীতি করলে এতগুলো বিসিএসে পাস করতে পারতাম না।’

রতন কির্ত্তনীয়া নামের আরেকজন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি কৃষি ব্যাংকে সিনিয়র অফিসার পদে কর্মরত ছিলাম। প্রথম গেজেটে নাম আসায় চাকরিটা ছেড়ে দিই।’ নিজের কোনো রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা না থাকার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি নিশ্চিত ছিলাম সিভিল সার্ভিসে যোগ দিতে পারব। কিন্তু গেজেট থেকে বাদ পড়ে এখন আমি বেকার।’

গেজেট থেকে বাদ পড়া সৈকত বিশ্বাস প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতাম। প্রথম গেজেটে নাম আসায় চাকরিটা ছেড়ে আমি এখন বেকার। দীর্ঘ চার বছরের বেশি সময়ের পরিশ্রম ও ধৈর্যের পর আজ যেখানে আমাদের বাকি ১ হাজার ৮৯৬ জনের সঙ্গে নিজ নিজ মন্ত্রাণলয়ে যোগ দেওয়ার কথা ছিল, সেখানে আমরা হতভাগ্য ২২৭ জন নিয়োগের অনিশ্চতায়। আমাদের কোনো অপরাধ নেই। আমাদের দ্রুত নিয়োগ দেওয়া হোক।’

৪৩তম বিসিএসের গেজেট থেকে বাদ পড়া প্রার্থীরা সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘দীর্ঘ চার বছরের শ্রম ও ত্যাগ–তিতিক্ষার পর ৪৩তম বিসিএসে আমরা বিভিন্ন ক্যাডারের নিয়োগের জন্য সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছিলাম। কিন্তু বিনা কারণে গেজেট থেকে বাদ পড়ায় এখন ২২৭টি পরিবার অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছি। ৯ জানুয়ারি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে আমাদের আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল, আমাদের নিয়োগের বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া হবে। কিন্তু আজ আমাদের ব্যাচের অন্য প্রার্থীরা চাকরিতে যোগদান করলেও আমাদের বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি।’

প্রার্থীরা আরও বলেন, ‘জনপ্রশাসন থেকে বলা হয়েছিল আমাদের ২২৭ জনের মধ্যে কারও বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা, রাষ্ট্রদ্রোহিতা বা শিক্ষাজীবনের বহিষ্কারাদেশ না থাকলে সবাই চাকরিতে নিয়োগ পাবে। ৯ জানুয়ারির পরপরই এ বিষয়ে গেজেট প্রকাশ করার কথা বলেছিল জনপ্রাশসন মন্ত্রণালয়। কিন্তু আজ চতুর্থ কর্মদিবস পার হলেও আমাদের জন্য সুখবর আসেনি। আমাদের একটাই দাবি, ২২৭ জনকে গেজেটভুক্ত করে দেশসেবার সুযোগ দেওয়া হোক।’

৯ জানুয়ারি ৪৩তম বিসিএস থেকে বাদ পড়াদের সঙ্গে বৈঠক শেষে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মোখলেস উর রহমান সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘৪৩তম বিসিএস থেকে বাদ পড়া ২২৭ জনের বিষয়ে আবার তদন্ত হয়েছে। ফৌজদারি অপরাধে জড়িত ছাড়া বাকিরা সবাই নিয়োগ পাবেন।’

৪৩তম বিসিএসে নিয়োগের জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় গত বছরের ১৫ অক্টোবরের প্রজ্ঞাপন বাতিল করে নতুন প্রজ্ঞাপন জারি করে গত ৩০ ডিসেম্বর। এতে বিভিন্ন ক্যাডারে বাদ পড়েন ১৬৮ জন প্রার্থী। এর আগে ১৫ অক্টোবরের প্রজ্ঞাপনে বিভিন্ন ক্যাডারে বাদ পড়েছিলেন ৯৯ জন। সব মিলিয়ে ৪৩তম বিসিএস থেকে বাদ পড়েন মোট ২৬৭ জন। ২৬৭ জনের মধ্যে স্বাস্থ্য পরীক্ষায় অনুপস্থিত ছিলেন ৪০ জন। ফলে এখন গেজেটবঞ্চিত প্রার্থীর সংখ্যা ২২৭। গেজেট থেকে বাদ না পড়লে এই ২২৭ জন প্রার্থী ৪৩তম বিসিএসের অন্য প্রার্থীদের সঙ্গে আজ ১৫ জানুয়ারি বিভিন্ন ক্যাডারে চাকরিতে যোগ দিতে পারতেন।

৪৩তম বিসিএসে গেজেটবঞ্চিত ২২৭ জন এবং রাজশাহীর সারদায় বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমিতে মৌলিক প্রশিক্ষণরত ২৫২ উপপরিদর্শককে (এসআই) বাদ দেওয়ার ‘যথোপযুক্ত কারণ’ অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে জানতে চেয়ে গত মঙ্গলবার গণমাধ্যমে বিবৃতি পাঠায় ‘বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক’। শিক্ষকেরা বলেছেন, জনগণের অংশ হিসেবে তাঁরা এর কারণ জানতে চান। সরকারের প্রদর্শিত যুক্তির গ্রহণযোগ্যতা না থাকলে অবিলম্বে এই প্রার্থীদের পুনর্ভুক্তির পক্ষে তাঁরা সরব থাকবেন। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সংগঠন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক। বিবৃতিতে ৪৮ জন শিক্ষক স্বাক্ষর করেন।

৪৩তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ হয়েছিল ২০২০ সালের ৩০ নভেম্বর। প্রিলিমিনারি, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা শেষে ২০২৩ সালের ২৬ ডিসেম্বর ২ হাজার ১৬৩ জনকে নিয়োগের সুপারিশ করেছিল সরকারি কর্ম কমিশন। ভেরিফিকেশন শেষে ৯৯ জনকে বাদ দিয়ে গত বছরের ১৫ অক্টোবর ২ হাজার ৬৪ জনকে চূড়ান্তভাবে নিয়োগ দিয়ে প্রথম গেজেট প্রকাশ করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এরপর ৩০ ডিসেম্বর ওই প্রজ্ঞাপন বাতিল করে প্রথম সুপারিশকৃত ২ হাজার ১৬৩ জন প্রার্থীর মধ্য থেকে স্বাস্থ্য পরীক্ষায় অনুপস্থিত ৪০ জন এবং গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন বিবেচনায় সাময়িকভাবে অনুপযুক্ত ২২৭ জনসহ মোট ২৬৭ জনকে বাদ দিয়ে ১ হাজার ৮৯৬ জনকে নিয়োগের দ্বিতীয় প্রজ্ঞাপন জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023 EU BANGLA NEWS