জেলার সীমান্ত ঘেঁষা ভোলাহাট উপজেলার মুশরীভূজা গ্রামের বাসিন্দা জিয়াউল হক। বয়সের ভারে তিনি অনেকটায় নুইয়ে পড়েছেন।দই উৎপাদন ও বিক্রির ৬৫ বছরের ব্যবসা এখন তার ছেলে ও স্বজনরা দেখেন, তবে তিনি এখনো দমে যাননি সমাজসেবা থেকে।
এ প্রতিবেদক যেতেই তিনি বের হয়ে গেলেন নিজ হাতে গড়া ১৪ হাজার বইয়ের পাঠাগারটি দেখাতে। বিভিন্ন ধরনের বইয়ে ঠাসা তার পাঠাগারে দুপুরেও পড়ায় মগ্ন ছিলেন স্থানীয় কয়েকজন। দেশি-বিদেশি, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নানা বইয়ের সংগ্রহ এতে।
পাঠাগারের এক কোণে শোভা পাচ্ছিল দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সংবর্ধনা পাওয়ার ক্রেস্ট। পাঠাগারে ঢুকেই জিয়াউল হক বইগুলো যত্ন সহকারে মুছতে শুরু করেন, মাঝে মাঝে আবার চোখ বোলান।
পাঠাগারের পাশেই তার বাড়িতে জেলার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের ভিড়। একনজর দেখতে ও শুভেচ্ছা জানাতে অনেকেই আসছেন ফুল নিয়ে। অনেকে আবার তার সাথে ছবি তুলে শেয়ার করছেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।
সমাজসেবায় বিশেষ অবদানের জন্য ২০২৪ সালে একুশে পদক পাচ্ছেন জিয়াউল হক। বিভিন্ন মাধ্যমে তাকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছে মানুষ।
বৃহস্পতিবার সকালেই ভোলাহাট উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা প্রশাসক এ কে এম গালিভ খাঁন তাকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান। ভোলাহাট উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাকে দেওয়া হয় সংবর্ধনা।
সৎ মানুষ এবং অতি উৎকৃষ্টমানের দই প্রস্তুতকারক হিসেবে তার নাম জেলা থেকে ছাড়িয়ে সারা দেশে। দই বিক্রির পাশাপাশি তিনি করে চলেছেন সমাজসেবা।
প্রথমে জিয়াউল হক অভাবগ্রস্ত মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে বিনামূল্যে পাঠ্যবই দিয়ে বছর শেষে আবার ফেরত নিয়ে আসতেন। এরপর তিনি স্থানীয় হাফেজিয়া মাদরাসা ও এতিমখানায় পাঠ্যবই, পবিত্র কোরআন মাজিদ ও এতিমদের পোশাক দেওয়া শুরু করেন।
বর্তমানে তিনি ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে স্নাতক পর্যন্ত বিজ্ঞান, কলা ও বাণিজ্য বিভাগে অনেক ছাত্রছাত্রীকে বিনামূল্যে পাঠ্যবই দিয়ে থাকেন। জেলার বাইরেও রাজশাহী বিভাগের বিভিন্ন কলেজের ছাত্রছাত্রীদেরও বই দেন তিনি।
যে ছাত্রছাত্রীরা দূর-দূরান্ত থেকে বই নিতে আসে, তাদের যাতায়াত খরচও দিয়ে থাকেন জিয়াউল হক। ঈদে গরিব দুঃখীর মধ্যে কাপড় বিতরণ এবং প্রচণ্ড শীতে দরিদ্রদের মাঝে শীতবস্ত্রও বিতরণ করেন।
জিয়াউল হক ১৯৩৮ সালে চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভোলাহাট উপজেলার মুশরীভূজা গ্রামের এক অতিদরিদ্র মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি জানান, ১৯৫৫ সালে পঞ্চম শ্রেণি পাস করার পর বাবার কাছ থেকে ষষ্ঠ শ্রেণির বই না পেয়ে পড়াশোনা বন্ধ হওয়ার আক্ষেপ থেকেই মূলত তার বিনামূল্যে বই বিতরণ, পাঠাগার স্থাপন এবং অন্যান্য সামাজিক কার্যক্রম পরিচালনা।
বাবাকে সাহায্য করার পাশাপাশি দই উৎপাদন শুরু করেন জিয়াউল হক। বেচি দই কিনি বই- এ স্লোগানকে সামনে রেখেই গড়ে তোলেন পাঠাগারটি। আক্ষেপ নিয়ে তিনি বলেন, দই বিক্রির পর তা দিয়ে পাঠাগার স্থাপন এবং গ্রামে বই বিতরণের কারণে অনেকেই তাকে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করতেন।
প্রয়াত স্ত্রী সারাবান তহুরার অনুপ্রেরণা ও নিজের দৃঢ় মনোভাবের কারণে পেছনে না ফিরে এগিয়ে গেছেন সামনে। এ কারণেই আজ তিনি চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলায় তিনটি মাদরাসা, একটি এতিমখানা, গোমস্তাপুর উপজেলায় দুটি মাদরাসা এবং নিজ উপজেলায় তিনটি মাদরাসা ও একটি এতিমখানা স্থাপন করতে পেরেছেন। যারা সেদিন বিদ্রুপ করেছিলেন, আজ তারা তাকে নিয়ে গর্ব করেন।
একুশে পদকপ্রাপ্তির জন্য সরকারের কাছে কৃতজ্ঞতা জানান জিয়াউল তিনি বলেন, আগামীতে আরও ভালো কাজ করার অনুপ্রেরণা যোগাবে এ পদক।
গত বছরের আগস্ট মাসে রাষ্ট্রীয়ভাবে একুশে পদকের জন্য তালিকা প্রস্তুত করা হয়। বিষয়টি জানতে পেরে তিনি যোগাযোগ করেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা প্রশাসক (ডিসি) এ কে এম গালিভ খাঁনের সঙ্গে। পরে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে ভোলাহাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কাছে যান।
তৎকালীন ইউএনও তার কাগজপত্র যাচাই-বাছাই শেষে চূড়ান্ত মনোনয়নের জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠান। এরপর ২০২৪ সালের একুশে পদকের জন্য তার নাম ঘোষণা করা হয়। গত মঙ্গলবার বিকেলে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের একজন উপসচিব কল করে প্রথমে তার মনোনীত হওয়ার বিষয়টি জানান।
একুশে পদকের জন্য মনোনীত হওয়ার বিষয়ে জিয়াউল হক বলেন, এ পদক শুধু আমার একার নয়, চাঁপাইনবাবগঞ্জবাসী এ জন্য গর্বিত। এ পদক আমার সমাজসেবাকে আরও অনুপ্রাণিত করবে। আমার মাধ্যমে শত শত মানুষ উপকৃত হচ্ছে। যত দিন বেঁচে থাকব, ততদিন মানুষের সেবা করে যেতে চাই।
জিয়াউল হকের ছেলে মহব্বত হক বলেন, আমি অত্যন্ত আনন্দিত। দই বিক্রির টাকা দিয়ে ১৯৬৯ সালে ভোলাহাট উপজেলার মুশরীভূজা গ্রামে জিয়াউল হক সাধারণ পাঠাগার প্রতিষ্ঠায় মায়ের অনুপ্রেরণা ছিল। আজ মা না থাকলেও বাবাকে দেশবাসী চিনছে। এ জন্য সরকারকে ধন্যবাদ জানাই।
দারুল হুদা জালালিয়া কওমি ও হাফিজিয়া মাদরাসার সভাপতি আজমল হক জানান, ’বেচি দই কিনি বই’ এ স্লোগানকে সামনে রেখে দই বিক্রির লাভের টাকা দিয়েই শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে বই প্রদান, দুস্থ শিক্ষার্থীদের বেতন দেওয়াসহ সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত অনুদান দেওয়ার পাশাপাশি জিয়াউল হক তিন উপজেলায় প্রতিষ্ঠা করেছেন আটটি মাদরাসা ও তিনটি এতিমখানা। এলাকার অনেক ধনী ব্যক্তিও যে এসব করে দেখাতে পারেননি, জিয়া ভাই তা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন।
ভোলাহাট উপজেলার দলদলী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোজাম্মেল হক বলেন, এমন একজন গুণী ব্যক্তিকে পেয়ে আমরা গর্বিত। তিনি সারা জীবন সমাজের জন্য কাজ করছেন। স্বীকৃতি হিসেবে দেশ তাকে একুশে পদক দিচ্ছে। এজন্য আমরা গর্বিত, একুশে পদকে জিয়াউল হককে মনোনীত করার জন্য আমরা কৃতজ্ঞ।
সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজনের ভোলাহাট শাখার সাধারণ সম্পাদক এ বি এম রুবেল আহম্মেদ জানান, একজন দই বিক্রেতার কাছে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে। তিনি একজন স্বল্প শিক্ষিত হয়েও ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ গড়ার কারিগর।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ সাহিত্য পরিষদের সহ-সভাপতি মো. শাহনেওয়াজ গামা বলেন, স্বল্পশিক্ষিত খেটে খাওয়া মানুষটিই আজ সমাজের জন্য অনুকরণীয় হয়ে থাকবেন।
জিয়াউল হকের হাতে সম্মাননার ক্রেস্ট তুলে দেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।