অবশেষে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। অপেক্ষার আর খুব বেশি বাকি নেই, রাত পোহালেই শুরু হবে ভোটযুদ্ধ। ইতোমধ্যে ভোটের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে নির্বাচন কমিশন। পুরো দেশ ও বিশ্ববাসীর নজর এখন ভোটের দিকে।
রোববার (৭ জানুয়ারি) সকাল ৮ টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত ২৯৯টি আসনে একটানা ভোট গ্রহণ চলবে। সব আসনেই ব্যালট পেপারে ভোট হবে। কোনো অনিয়ম হলে তাৎক্ষণিক প্রার্থীতা বাতিলসহ প্রয়োজনে ভোট বন্ধ করে দেওয়া হবে বলে হুঁশিয়ার করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল।
ভোটে অংশ নিচ্ছে ২৮টি দল
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দেশের মোট ২৮টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল অংশ নিচ্ছে। দলগুলো হলো- বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, জাতীয় পার্টি (জেপি), জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), তৃণমূল বিএনপি, ইসলামী ফ্রন্ট বাংলাদেশ, ইসলামী ঐক্যজোট, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, গণফোরাম, গণফ্রন্ট, জাকের পার্টি, ন্যাশনাল পিপলস পার্টি, বিকল্প ধারা বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট, বাংলাদেশ কংগ্রেস, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন, বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশন, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ), বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট (বিএনএফ), বাংলাদেশ মুসলিম লীগ, বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি, বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোট, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল (এম.এল) এবং গণতন্ত্রী পার্টি।
ভোটের মাঠে ১৯৭১ প্রার্থী
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১ হাজার ৯৭১ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এর মধ্যে ২৮টি রাজনৈতিক দলের প্রার্থী রয়েছেন ১ হাজার ৫৩৫ জন। এর বাইরে ৪৩৬ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী রয়েছেন। সবচেয়ে বেশি প্রার্থী রয়েছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ থেকে। দলটির মোট ২৬৬ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এরপর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ প্রার্থী জাতীয় পার্টির ২৬৫ জন। এরপর তৃতীয় সর্বোচ্চ প্রার্থী তৃণমূল বিএনপির ১৩৫ জন। এ ছাড়া ন্যাশনাল পিপলস পার্টির ১২২ জন প্রার্থী রয়েছেন। এর বাহিরে যে দলগুলো ভোটে অংশ নিচ্ছে সবগুলো দলের প্রার্থী এক শ’র নিচে। সবচেয়ে কম প্রার্থী রয়েছে বাংলাদেশ মুসলিম-লীগ এবং বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী) এর। দুটি দল থেকে চার জন করে প্রার্থী রয়েছেন।
ভোটের মাঠে ৯০ নারী প্রার্থী
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সারাদেশে দলীয় ও স্বতন্ত্র থেকে মোট ৯০ নারী প্রার্থী ভোটে অংশগ্রহণ করছেন। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ থেকে ১৮ জন ও জাতীয় পার্টির ৭ জন রয়েছেন। এ ছাড়া স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ২৩ জন নারী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। অন্যদিকে, বিভিন্ন আসন থেকে ৭৯ জন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর প্রার্থী নির্বাচনের মাঠে লড়াই করবেন। পাশাপাশি এই নির্বাচনে তৃতীয় লিঙ্গের একজন প্রার্থী রয়েছেন।
পর্যবেক্ষণে ৩৪ দেশের ১২৬ বিদেশি
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যবেক্ষণের জন্য ২২৭ জন বিদেশি নির্বাচন কমিশনে আবেদন করেছিলেন। এর মধ্যে মোট ১২৬ জন বিদেশিকে নির্বাচনে পর্যবেক্ষণের অনুমতি দিয়েছে কমিশন। ৩৪ দেশের এসব বিদেশি পর্যবেক্ষকের পাশাপাশি ওআইসি, সার্ক, ফেমবোসা ও কমনওয়েলথের মতো সংস্থাগুলোও নির্বাচন পর্যবেক্ষণে নিজেদের প্রতিনিধি পাঠিয়েছে। ইসির অনুমোদন পাওয়া তালিকায় যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ফ্রান্স, জাপান, ভারত, পোল্যান্ড, ফিলিস্তিন, বেলজিয়াম, পর্তুগাল, নেদারল্যান্ডস, জর্ডান, আয়ারল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ ও ভুটানের নাগরিক রয়েছেন। এবার ৭৬ জন বিদেশি সাংবাদিক নির্বাচনের দিন সংবাদ সংগ্রহের জন্য মাঠে থাকবেন।
মোট ভোটার প্রায় ১২ কোটি
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মোট ভোটার রয়েছেন ১১ কোটি ৯৩ লাখ ৩২ হাজার ৯৩৪ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ৬ কোটি ৫ লাখ ৯২ হাজার ১৯৭ জন ও নারী ভোটার ৫ কোটি ৮৭ লাখ ৩৯ হাজার ৮৮৯ জন। এ ছাড়া তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার রয়েছেন ৮৪৮ জন। নওগাঁ-২ আসনের একজন বৈধ প্রার্থী মারা যাওয়ায় আসনটির ভোট স্থগিত করা হয়েছে। ফলে ২৯৯টি আসনে ভোট হবে।
বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর ভোট বর্জন
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দেশের ২৮টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল অংশ নিচ্ছে। তবে ভোটে অংশ নিচ্ছে না রাজপথের প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ সমমনা বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল। বেশ কয়েকদিন ধরেই তারা বর্তমান সরকারের পদত্যাগ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে আসছিল। সবশেষে তারা দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ‘একতরফা’ ও ‘ডামি’ নির্বাচন আখ্যা দিয়ে জনগণকে ভোট থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানাচ্ছে। নির্বাচন বর্জন ও অসহযোগ আন্দোলনের পক্ষে শনিবার (৬ জানুয়ারি) সকাল ৬টা থেকে বিএনপির ৪৮ ঘণ্টার হরতাল শুরু হয়েছে। হরতাল চলবে সোমবার (৮ জানুয়ারি) সকাল ৬টা পর্যন্ত। এ ছাড়া একই কর্মসূচি পালন করছে জামায়াতে ইসলামী ও লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি) সহ অন্যান্য দলগুলো।
নির্বাচন ঘিরে নিরাপত্তা জোরদার
সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য মাঠে থাকছে র্যাব, পুলিশ, আনসার, বিজিবি, কোস্টগার্ড, এপিবিএনের সাড়ে সাত লাখ ফোর্স। ভোটের আগে-পরে ১৩ দিন থাকছে সেনাবাহিনী। গত ৩ জানুয়ারি থেকে স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে মাঠে রয়েছে বাহিনীটির বিপুল সংখ্যক সদস্য। এবার ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রগুলোতে পুলিশের বাড়তি ফোর্স মোতায়েন রয়েছে। পাশাপাশি নির্বাচন ঘিরে যেকোনো অনিয়মের তাৎক্ষণিক বিচার করতে মাঠে রয়েছে ৬৫৩ জন বিচারিক হাকিম। ভোট দানে বাধা দিলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে হুঁশিয়ার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর কর্মকর্তারা।
র্যাব মহাপরিচালক (ডিজি) অতিরিক্ত আইজিপি এম খুরশীদ হোসেন বলেন, বিএনপি-জামায়াত ও কিছু দল নির্বাচন বয়কটের ঘোষণা দিয়েছে। কেউ ভোট দিতেও পারে, নাও পারে। তবে কেউ ভোট দিতে চাইলে তাকে বাধা দেওয়া বেআইনি। এই কাজ যারা করবে তাদের কঠোরভাবে দমন করা হবে।
সব বেসরকারি হাসপাতাল প্রস্তুত
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে যেকোনো জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলায় আগামী ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত দেশের সব বেসরকারি ক্লিনিক ও হাসপাতাল প্রস্তুত রাখার নির্দেশ দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এসময়ে নিয়মিত স্বাস্থ্যসেবাও চালু রাখতে বলা হয়েছে। শুক্রবার (৫ জানুয়ারি) এমন নির্দেশনা দেওয়া হয়। যে কোনো রোগীকে সরকারি হাসপাতালে রেফার করার ক্ষেত্রে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে সংশ্লিষ্ট হাসপাতালে যোগাযোগ করে অ্যাম্বুলেন্সের মাধ্যমে পাঠাতে বলা হয়েছে।
অনিয়মের বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে শনিবার (৬ জানুয়ারি) সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল। ভাষণে তিনি জাল ভোটসহ যে কোনো অনিয়মের বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন।
সিইসি বলেন, সব প্রার্থী ও ভোটারদের নির্বাচনী বিধিবিধান অনুসরণ করতে হবে। নির্বাচনের দায়িত্ব নিয়োজিত সব কর্মকর্তাকেও সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে হবে। কোনো প্রকার অসততা, ব্যত্যয় ও অবহেলা সহ্য করা হবে না। কোনো প্রার্থী বা প্রার্থীর পক্ষে জাল ভোট, ভোট কারচুপি, ব্যালট ছিনতাই বা পেশীশক্তির ব্যবহার কঠোরভাবে প্রতিহত করা হবে। এ ধরনের কর্মকাণ্ডের তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেলে তাৎক্ষণিকভাবে প্রার্থীতা বাতিল ও প্রয়োজনে কেন্দ্র বা নির্বাচনী এলাকার ভোটগ্রহণ বন্ধ করে দেওয়া হবে।
তিনি আরও বলেন, এবারের নির্বাচনে ২৮টি দল অংশ নিচ্ছে। সর্বমোট ১৯৭১ জন প্রার্থী ২৯৯টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। ফলে নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন ও অংশগ্রহণমূলক নয় বলে আখ্যায়িত করা যাবে না।